ইপিএফও-র ক্ষেত্রে সুদ কমিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও, নতুন রেট-নির্ভর প্রতিশ্রুতি পালন করা খুব দুরূহ কাজ। ডেট অরিয়েন্টেড কৌশল অথবা বিশেষ কোনও জাদুমন্ত্র ব্যবহার করে উন্নত রিটার্ন আনাও হবে মুশকিল। তাহলে কোন খাতে বিনিয়োগকারী তাঁর সম্পদ গচ্ছিত রাখবেন, যেখানে রিটার্ন নিশ্চিত? লিখছেন নীলাঞ্জন দে
একধাক্কায় ‘ইপিএফও’-র (‘এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড অর্গানাইজেশন’) বার্ষিক সুদের হার ৮.১ শতাংশ হয়ে গেল, রিটায়ারমেন্ট সেভিংসের ক্ষেত্রে উদ্বেগ অনেকটা বাড়িয়ে। ভোঁতা হয়ে গেল মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে চলা অসম লড়াইয়ে ব্যবহার করা এক হাতিয়ার, ভেঙে গেল অবসরমুখী মানুষের লাইফস্টাইল অটুট রাখার স্বপ্ন, ধাক্কা লাগল সুচারুভাবে গঠিত অনেক রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানে।
তবে এই লেখা কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে নয়, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সামাজিক সুরক্ষার পন্থার হদিশ দেখানো অর্গানাইজেশনের ২৫ কোটি সাবস্ক্রাইবারের মনোবল বাড়ানোর প্রয়াসও নয়। একটি কথা স্পষ্ট বলার উদ্দেশ্যে বরং কলম ধরা। জোর গলায় জানাতে চাই, ইপিএফও-র সুদ কমিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও, নতুন রেট-নির্ভর প্রতিশ্রুতি পালন করা খুব দুরূহ কাজ। এই বাজারে ৮.১ শতাংশ হারে, নির্দিষ্ট উপায়ে সম্পদ বাড়িয়ে গ্রাহকদের তুষ্ট করা এক অসম্ভব চ্যালেঞ্জের সমতুল্য। কারণটি বুঝতে বেশি দূর যেতে হবে না। ডেট মার্কেটের উপর চূড়ান্ত নির্ভরশীল থেকে এভাবে প্রতিজ্ঞা রাখার চেষ্টা সার্বিকভাবে সফল না-ও হতে পারে। তলিয়ে ভাবার আগে একটু পিছনে তাকানো যাক।
ইপিএফও-র ইনভেস্টমেন্ট পদ্ধতি যদি দেখেন, তাহলে বুঝবেন এখানে ঋণপত্রের প্রাধান্য কতখানি। বহুলাংশে ডেট মার্কেটেই বিনিয়োগ করা হয়, এবং তার একটি বড় অংশ ‘গভর্নমেন্ট সিকিউরিটিজ’-এ (চলতি ভাষায়, ‘গিল্টস’)। ইদানীং, এদেশের সরকার মার্কেটমুখী হওয়ার দরুন ‘ইকুইটি’ (মানে শেয়ার) নিয়ে উৎসাহী হয়েছে, ছোট একটি অংশ স্টক মার্কেটে লগ্নি করা হচ্ছে। তবে স্বাভাবিকভাবেই, সেই লগ্নির অনেক নিয়ম-কানুন আছে, নিয়ন্ত্রণনীতি বেশ কড়া ধরনের। ইনডেক্স-ভিত্তিক বিনিয়োগ এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডের মাধ্যমে সাম্প্রতিক কালে করা হয়েছে।
ডেট মার্কেটে বিনিয়োগকারীগণ নিশ্চয়ই জানবেন, ইন্টারেস্ট একান্তভাবেই রেট নির্ভর। সামগ্রিকভাবে যখন দেশে সুদের হার বাড়ে, তখন ঋণপত্রের ভ্যালুয়েশন কমে। এই ‘ইনভার্স রিলেশনশিপ’ নিয়ে বিশ্বব্যাপী চর্চা প্রতিনিয়ত চলছে- বিশেষত এই এখনকার পৃথিবীতে, যেখানে একাধিক দেশে সুদের হার উর্ধ্বমুখী রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। আর, তা হবে না-ই বা কেন? ইনফ্লেশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে সুদ বাড়াতে রাজি হবে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কগুলি। মার্কিন মুলুকের ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রক ‘ফেডারাল রিজার্ভ সিস্টেম’ ইতিমধে্য এ ব্যাপারে এক পা এগিয়েই রেখেছে। তবে আমাদের দেশে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এখনও তার নিজস্ব ‘অ্যাকোমোডেটিভ’ পদ্ধতি অনুসরণ করছে। বাজারের একটি বড় অংশ কিন্তু পরের মনেটারি পলিসি সংক্রান্ত ঘোষণার অপেক্ষায়। অবশ্য ঠিক পরের ঘোষণাতেই অন্য আন্দাজ পাওয়া যাবে- তাও ঠিক বলা যাচ্ছে না, হয়তো এক-দু’টি কোয়ার্টার ছেড়েই দেবে ভারতীয় ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রক।
সে যাই হোক, মোদ্দাকথাটি খুব সরল- সুদ যদি বাড়ে, ঋণপত্রের ভ্যালুয়েশন যদি কমে, তাহলে তো ডেট মার্কেটের নানা কোণে তার প্রতিফলন দেখতে পাব আমরা। ডেট ওরিয়েন্টেড কৌশল তো বিশেষ কোনও জাদুমন্ত্র ব্যবহার করে উন্নত রিটার্ন আনতে সক্ষম হবে না। কোন সাহসে তাহলে বিনিয়োগকারী ঋণপত্রে তঁার সম্পদ গচ্ছিত রাখবেন। বলা বাহুল্য, রিটার্ন হবে স্বল্প। তবে হ্যাঁ, গভর্নমেন্ট সিকিউরিটিজে সুরক্ষার কোনও অভাব হবে না। এই শেষোক্ত কথাটি অনুধাবন করুন বিশেষভাবে। ক্রেডিট রিস্ক নেই, এককথায় আপনার সম্পদ থাকবে একান্তভাবে সুরক্ষিত। সরকারি সিকিউরিটিজের বাইরে যা প্রাইভেট সংস্থার বন্ড থাকবে, সেগুলিও যেন ভাল রেটিং প্রাপ্ত হয়। তবে সেখানেও রিটার্ন আহামরি রকমের পাওয়া যাবে না, তা এখনই বলে রাখি।
উপায়? আমার মতে একটাই। ইপিএফও-র লগ্নির পরিধির মাপ-বহর বাড়িয়ে, আরও বাজার-নির্ভর অ্যাসেট বেছে নিতেই হবে। তবে তা সমস্ত সাধারণ নীতি, যেগুলি বাজারে সহজেই গ্রহণীয় হয়েছে, জলাঞ্জলি দিয়ে কখনওই নয়। একটু বিশদে বলি- আপনি লগ্নিকারী হোন বা না হোন, আমার লজিক হয়তো সমর্থনযোগ্য মনে হবে। চুম্বকে, ইনডেক্সে আছে এমন স্টকে বিনিয়োগ আরও বেশি মাত্রায় করা দরকার, সেটা রিটার্নের স্বার্থেই, কর্পোরেট কর্তাদের ‘ডজ’ না করার জন্য আদপেই নয়। শেষ কথাটি সবিশেষ লক্ষণীয়, কারণ বহু বিতর্কের শুরু এই সূত্র ধরেই হয়েছে অতীতে। বিতর্ক চাই না, তবে বলে রাখা উচিত যে ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস’ (checks and balances) সুদৃঢ় রাখতে হবে, পারফরম্যান্সের তাগিদে সে সমস্ত যেন অদৃশ্য না হয়ে যায়, তাও দেখতে হবে। আরও জানিয়ে রাখি ইনডেক্সে থাকা স্টকগুলির সমর্থনে কিছু কথা। এগুলি নানা কারণে বিনিয়োগকারীদের মধে্য জনপ্রিয়, পেশাদার লগ্নি এর ভিত্তিতে করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, অগ্রণী ভারতীয় ইনডেক্স, নিফটি-র (Nifty) ব্যাপারে বলতে পারি। অতি বৃহদাকার কোম্পানিগুলির স্টক এই সূচকের অন্তর্ভুক্ত, সেগুলির মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন বিশাল, লিকুইডিটি নিয়ে কোনও সন্দেহ প্রকাশ করার অবকাশ নেই। ভারতীয় স্টক মার্কেট নিফটি-কে বাদ দিয়ে ভাবাই যাবে না।
এত কিছু বলার উদ্দেশ্য, ইপিএফও-কে নিফটি বা অনুরূপ কোনও সূচক সম্বন্ধে ভাবতে হবে আরও বেশি করে। আগেই বলেছি ‘এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড’ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে, তার বিস্তার প্রয়োজন। নয়তো কিছুতেই সুষ্ঠু রকমের রিটার্ন পাওয়া সম্ভব নয়। এত অবধি লিখে ভাবলাম পাঠক ভুল কোনও বার্তা পাচ্ছেন না তো? তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবছেন না যে, আমরা ইপিএফওর মতো সংস্থাকে আর পঁাচজনের মতো দেখছি, মার্কেটে ট্রেড করতে বলছি। না, তা আদপেই নয়, বরং বলছি বাজারে রীতিমতো থেকে, নিজের ইনভেস্টমেন্ট কৌশল প্রয়োগ করে খোলা মার্কেটের পূর্ণ সুযোগ নিতে। তাই স্রেফ লিকুইডিটি ইত্যাদির কারণ দর্শালে চলবে না, সমস্ত সাবস্ক্রাইবারকে বোঝাতে হবে বাজারমুখী হওয়ার সুবিধাগুলো কী হতে পারে। এছাড়াও ইনডেক্সের মাধ্যমে কীভাবে ‘কস্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট’ কমের দিকে রাখা যায়, তাও হাতে-কলমে দেখিয়ে দিতে হবে। পোর্টফোলিও সম্বন্ধে স্বচ্ছভাবে সমস্ত দরকারি তথ্যও দেওয়া দরকার। নতুবা গ্রাহক জানবেন কীভাবে তাঁর টাকা (অন্তত সেই অংশটি, যেটি সরকারি ঋণপত্রে বিনিয়োগ হচ্ছে না) বাজারে ‘খাটছে’।
হ্যাঁ, কথাটি ‘খাটুনি’ সংক্রান্ত, ইচ্ছা করে লিখেছি। মনে রাখবেন, ইপিএফও-র আয়তন বিপুল, গত বছর মার্চ মাসের শেষে সেটির কর্পাস ছিল প্রায় ১৬ হাজার বিলিয়ন টাকা (মার্কিন ডলারে ২১০ বিলিয়নের কাছাকাছি)। শুধু ডলার-রুপি জাতীয় তথ্যের ভারে যদি নুয়ে না পড়তে চান, তাহলে জেনে রাখতে পারেন যে ‘অ্যাসেট আন্ডার ম্যানেজমেন্ট’-এর নিরিখে, ইপিএফও বিশ্বজোড়া পেনশন ফান্ডের জগতে ৮ নম্বর স্থানে। আর মেম্বরশিপের পরিসংখ্যান যদি চান, তাহলে এটি পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম সংস্থা। মোটকথা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন, ইনসিওরেন্সের পরিপেক্ষিতে ইপিএফও-র সংসার জমজমাট।
পরিসংখ্যানের শরনিক্ষেপ করছি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। এত বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও অর্গানাইজেশনটির ‘সারপ্লাস’ তেমন বিরাট কিছু নয়। যদিও ৪৫০ কোটি টাকার উদ্বৃত্ত থাকছে বলে জানা যাচ্ছে। এই সংখ্যাটি না বাড়লে অস্বস্তির কারণ থেকেই যাবে তা বলা বাহুল্য। এই প্রসঙ্গেও বলা যাক যে, সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এখানেও ইকুইটির নির্দিষ্ট একটি রোল তথা উপযোগিতা রয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে, করোনার প্রবল অসুবিধার মধে্যও, স্টক মার্কেটে যে উত্থান দেখা গিয়েছে, তাতে উপকৃত হয়েছে বহু বিনিয়োগকারী। ইপিএফও তার ব্যতিক্রম নয়। ঘটনাচক্রে, যদি পুরনো রেট, অর্থাৎ ৮.৫ শতাংশ আজও বহাল থাকত, তাহলে এই উদ্বৃত্ত তৈরি তো হতই না, ডেফিসিট (Deficit) সৃষ্টি হত। সেই অবস্থায় কি সোশ্যাল সিকিউরিটি মানে সামাজিক সুরক্ষা, এবং সেই সংক্রান্ত আদর্শগত অবস্থান মেনে চলা সম্ভব হত? এককথায়, না।
একথা সবাই মানবেন, সোশ্যাল সিকিউরিটি প্রদান করা আমাদের মতো দরিদ্র দেশের পক্ষে ভীষণ জরুরি। কাজেই নতুন গ্রাহক না এলেই নয়, মেম্বারশিপ বেস না বাড়লেই নয়। ইতিমধ্যে নানা ধরনের প্রচেষ্টার ফলে সেই বেস বাড়ছে বলে খবরে প্রকাশ। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ১৪.৬ লক্ষ ‘নেট সাবস্ক্রাইবার’ যোগ দিয়েছেন এই নেটওয়ার্কে। এঁদের মধ্যে অনেকেই নানা শ্রেণির সার্ভিস সেক্টরের কর্মী। সরকারি তথ্য জানাচ্ছে, ম্যানপাওয়ার এজেন্সি, প্রাইভেট সিকিউরিটি সংস্থা, ক্ষুদ্র কনট্র্যাক্টর- সব মিলিয়ে বেশ কিছু নতুন ধরনের ক্ষেত্র থেকে কর্মীরা আসছেন। নেট পে-রোলে অ্যাডিশনের নিরিখে কনস্ট্রাকশন, টেক্সটাইল এবং রেস্তরাঁ সেক্টরে কর্মরত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
নতুন গ্রাহকরা আসছেন, এ তো সুখবর। তবে দেখতে হবে অন্য সরকারি প্রকল্পের তুলনীয় কি কিছু পাওয়া সম্ভব? হালের স্মল সেভিংস প্রকল্পগুলো পরীক্ষা করলে উত্তর ‘না’ হবে। তাও, ইপিএফও-র নতুন রেট যদি দেখেন, এবং রেট যদি পরেরবার আরও কমে, তাহলে অনেকেই অন্য কিছু ভেবে নিয়ে তাদের রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানিং করতে পারেন, তাই নয় কি? অবশ্যই সুদের হার এখানে এই মুহূর্তে অনেকটাই বেশি, শর্তগুলোও আলাদা, তাও সে সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
আগামী দিনে সুরক্ষার পাশাপাশি ভাল রিটার্নও চাইবেন নব্য গ্রাহক, তাঁর অবসরের কথা ভেবেই তা যথার্থ চাহিদাই হবে, অন্যায্য কিছু হবে না। প্রতিশ্রুতি মতো সম্পদ বৃদ্ধির পন্থা, নিয়মমাফিক উইথড্রয়ালের শর্ত, স্বচ্ছতা, আয়কর ছাড়- এসবই বিনিয়োগকারীরা খেয়াল করে চলেন। একই প্রকল্পে এত কিছু দেওয়া কার্যত অসম্ভব। তারপর প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে আসে পারফরম্যান্স। ইকুইটির মাধ্যমে তা যদি তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া যায়, দীর্ঘমেয়াদি অবসর-মনস্ক বিনিয়োগের বাতাবরণ তৈরি করা যায়, তাই বা মন্দ কী?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিনিয়োগ উপদেষ্টা
[email protected]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.