মনিরুল ইসলাম, উলুবেড়িয়া: বিদ্যুতের প্লাগ পয়েন্ট থেকে টেলিভিশনের প্লাগ খোলা পড়ে রয়েছে টেবিলের উপরেই। ধুলো জমেছে সেটির উপর। রিমোট কন্ট্রোলও পড়ে রয়েছে টেলিভিশনের উপরে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জমে থাকা ধুলোর আস্তরণটি। দেখেই মনে হচ্ছে কয়েক মাস হাত পড়েনি রিমোটে। বাড়িতে টেলিভিশনটি চলেনি কয়েক মাস৷ গোটা বাড়িটাই কার্যত অগোছালো। তবে বাড়ির দেওয়াল আলমারিতে থরে থরে সাজানো রয়েছে বীর সৈনিক সন্তানের ছবি। বেশ যত্ন করেই রাখা রয়েছে ছবির অ্যালবামগুলো। হ্যাঁ, বীর সৈনিক সন্তান বাবলু সাঁতরার বাড়ি এটি। মাত্র কয়েক মাস আগে যিনি দেশমায়ের জন্য শহিদ হয়েছেন। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গিদের করা গাড়ি বিস্ফোরণে তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন।
বাউড়িয়ার চককাশীতে টোটো থেকে নেমে বাবলু সাঁতরার বাড়ির দিকে যাওয়ার রাস্তার পাশেই একটি কাপড়ের দোকান। দোকানের দেওয়ালে আঁকা জোড়াফুল। এরই পিছনে বামেদের পার্টি অফিস। আবার বামেদের পার্টি অফিসের উলটো দিকে পঞ্চাশ মিটারের মধ্যেই তৃণমূলের পার্টি অফিস। পার্টি অফিসের কাছে একটি গাছের তলায় কয়েকজন রাজনীতির কথাবার্তায় ব্যস্ত। কিছুটা দূরে কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কলকাতায় আসা নিয়ে কথা বলছেন। শোনা গেল এখান থেকে একটা গাড়ি নাকি ব্রিগেডে মোদির সভায় গিয়েছে। বামেদের পার্টি অফিসের সামনের এক দেওয়ালে আঁকা কাস্তে, হাতুড়ি, তারা। অন্য দেওয়ালে লেখা বাম প্রার্থীর নাম। লেখা রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর নামও। তাই বলা যায় ভোটের হাওয়ায় সরগরম বাউড়িয়ার চককাশী এলাকা। সেখানে ছিলেন উলুবেড়িয়া পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর অসিরঞ্জন অধিকারী। তিনি বললেন, “প্রচার শুরু হয়েছে। ভোটের উত্তাপ শুরু হয়েছে, ধীরে ধীরে সেই উত্তাপ আরও বাড়বে।” একই কথা জানালেন দোকানদার চন্দন দত্তও। বাবলুদের বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে উঠোনে ঢুকতেই দেখা গেল দোতলা বাড়ির সামনেই টাঙানো রয়েছে কয়েকটি ফেস্টুন। সেখানে রয়েছে বাবলু সাঁতরার সৈনিকবেশে ছবি। তাতে লেখা, ‘অমর বাবলুকে আমরা সবসময়ই মনে রাখব’।
[আরও পড়ুন: বিয়ের উপহার হিসেবে পাওয়া সব অর্থ সেনা খাতে দেবেন CRPF জওয়ান]
সামনে তো ভোট, ভোটের খবর টেলিভিশনে দেখেন? “না। ওঁর মৃত্যুর দিন থেকেই এই ঘরে বন্ধ টেলিভিশন,” সোজাসাপটা উত্তর শহিদ বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতা সাঁতরার। তাঁর বক্তব্য, তবে সচেতন নাগরিক হিসাবে মোবাইলে খবর দেখি। তাঁর কথার প্রমাণ মিলল ঘরের ও টেলিভিশনের অবস্থা দেখেই। ধুলো জমা রিমোটই বলে দিচ্ছে যে, মাস খানেক তাতে কেউ হাত দেয়নি। এমনকী বাবলুবাবুর ছোট্ট মেয়েটিও না। দ্বিতীয় প্রশ্ন, সামনে তো ভোট। ভোট দেবেন? আবার স্পষ্ট উত্তর, এখনও ঠিক করিনি। টেবিলের উপরে রাখা একটি কাগজে পেন দিয়ে কিছু একটা লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। মুখে এক চিলতে হাসির লেশমাত্র থাকা তো দূর অস্ত। বরং অত্যন্ত গম্ভীরভাবে প্রশ্নের উত্তরগুলো মিতাদেবী দিচ্ছিলেন। সব দলই তো প্রচার শুরু করে দিয়েছে। আপনাদের বাড়িতে রাজনীতির লোকেরা আসেন। অবশ্য জানা গেল সব দলের লোকেরাই আসেন। মিতার সংক্ষিপ্ত উত্তর, “নিজেদের প্রয়োজনে।” বোঝা গেল ভোট রাজনীতির উত্তাপ যেন এখানে হিমশীতল। পরিবারের সবচেয়ে কঠিন সময়ও অবশ্য মিতা ছিলেন শক্ত। নিজের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদকে হারিয়েও তিনি দেশে শান্তির কথা বলেছিলেন। দেশের অন্য সৈনিকের স্ত্রী বা মায়ের কোল যাতে না খালি হয় সেজন্য যুদ্ধের জিগিরের প্রতিকূলেও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তাঁর বার্তা ছিল, যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়। এখনও জারি সেই লড়াই। এদিনও তিনি ঠিক তেমনই কঠিন। চাকরির ব্যবস্থা কিছু হয়েছে কি না জানতে চাওয়ায়, মিতা জানালেন যা হবে ভোটের পর, এমনটাই জানিয়েছেন নেতারা। নানা দিক থেকে সাহায্য যদিও মিতা পেয়েছেন। তবু জীবন সংগ্রামে প্রতিদিনই যে তাঁকে নিজের মতো করে লড়তে হচ্ছে।
ততক্ষণে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন বাবলু সাঁতরার মা বনমালাদেবী। তিনি কার্যত নিস্পৃহ ছিলেন। মিতার চেয়ারের পাশে থাকা চেয়ারটিতে বসলেন তিনি। এবার ভোট দেবেন? গলা থেকে কথা সরছে না, নির্বাক দৃষ্টি, অপলক নয়ন। হঠাৎই কেঁপে উঠল তাঁর ঠোঁট দু’টি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.