সুব্রত বিশ্বাস, কুলপি: পলি ছেনে মাটি তৈরিতে ব্যস্ত দুলারি। পাশে একরত্তি শিশু হাত লাগিয়েছে মায়ের সঙ্গে। হাড় জিরজিরে শরীর দু’জনেরই। অভুক্ত শরীর জুত পায় না। তবু কাজ না করলে পেট চলবে না। বিহারের তিন পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুধু পেটের জ্বালায় মথুরাপুর লোকসভার কুলপি ব্লকে সপরিবার চলে এসেছেন তাঁরা।
স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ইটভাটার কাঁচা মাল যোগান দেওয়ার লেবার। একরত্তি শিশুটিকেও শ্রমিকে পরিণত করে তুলতে চান দু’জনেই। বড় হলে দুটো খেতে পাবে, এমনই পরিকল্পনা বাবা-মায়ের। ইটভাটার দূষিত ধোঁয়া শরীরের কতটা মারাত্মক ক্ষতি করছে, তা জানেন না বাবুলাল ও দুলারি। বাবুলাল ও দুলারির মতো এবিষয়ে অজ্ঞ কুলপি ব্লকের চুয়াল্লিশটি ইটভাটার কয়েক হাজার শ্রমিক। তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার নদী উপকূলবর্তী ৪৪টি ইটভাটার অধিকাংশই কুলপি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে। কুলপি, রামকৃষ্ণপুর, রামকিশোরপুর, বিস্তর এলাকাজুড়ে ইটভাটা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র দূষণ। নদীর পলি কেটে নেওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে বিপজ্জনক পরিস্থিতি। স্থানীয় জগদীশ মাইতি অভিযোগের সুরে বলেন, বেশ কিছু ভাটা-মালিক বেপরোয়া। যেমন খুশি মেশিন লাগিয়ে পলি কেটে নিচ্ছেন। প্রশাসনে জানিয়েও কিছু হয়নি। শুধু রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ব্যস্ত সব দল।
২০১৫ সালে গ্রিন ট্রাইবুনালের দেওয়া রিপোর্টের পর প্রশাসন জানিয়েছিল, বন্ধ করে দেওয়া হবে এই ভাটা। তবু বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে রমরমিয়ে। ইটভাটার কোক ও টায়ার জাতীয় বস্তু পোড়ানোয় নদীর উপকূলবর্তী অঞ্চলের কৃষিজমি উর্বরতা হারাচ্ছে। প্রশাসন ঠুঁঠো জগন্নাথ। ইটভাটাগুলো তৃণমূলের সিন্ডিকেটের জায়াগা হয়ে গিয়েছে বলে সরাসরি অভিযোগ করলেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা বিজেপি পশ্চিম জেলা সভাপতি সুফল ঘঁটু। ইটভাটা যে মানবজীবনে চরম সমস্যার তা স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি কুলপির তৃণমূল বিধায়ক যোগরঞ্জন হালদার। রাখঢাক না করেই তিনি বলেন, বারো হাজারেরও বেশি মানুষ ইটভাটায় কাজ করেন। এখানে শিল্প-কারাখানা নেই। ভাটার উপর নির্ভর করে হাটবাজার চলে। দোকানপাট থেকে রুজি রোজগার সবই নির্ভর করে শতাধিক বছর আগে তৈরি হওয়া এই সব ভাটার উপর। ভাটা বন্ধ হলে চরম পরিণতি দেখা দেবে।
বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের থেকে হতদরিদ্র মানুষ এই ভাটার কাজে আসে। আজকাল বসিরহাট, বনগাঁ থেকেও মানুষজন কাজে আসছে। পরিবার নিয়ে থাকছেন। তাদের শিশুদের শিক্ষার কোনও সুযোগ নেই। দু’টি এনজিওর মাধ্যমে পড়াশোনা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে কোনও অজানা কারণে।
সমস্যা সমাধানের পথ নেই। আছে রাজনৈতিক চাপ। চাপের মুখেই নিয়ন্ত্রিত হয় ভোট। মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্র তার বাইরে নয়। বাংলায় পরিবর্তন আসার আগেই বামদূর্গে ধাক্কা মেরেছিলেন চৌধুরি মোহন জাটুয়া। ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের অনিমেষ লস্করকে হারিয়ে বামেদের কুড়ি বছরের আধিপত্য ভেঙ্গে দেন। তখন থেকে তৃণমূলের চৌধুরি মোহনই মথুরাপুরের সাংসদ। এবার তিনি হ্যাটট্রিকের সামনে। তারপর বাংলাজুড়েই এল পরিবর্তন। কিন্তু এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা একটুও বদলাল না। সেই ধোঁয়া, সেই আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পলি কেটে চলা। হাজার হাজার ইটভাটা শ্রমিকের জীবন সংগ্রাম সেই একইরকম। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে এখানে একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বিজেপি। শ্যামাপ্রসাদ হালদারের সমর্থনে উল্লোনে সভাও করে গেলেন নরেন্দ্র মোদি। এখানকার গেরুয়া নেতৃত্বের দাবি, অবাধ নির্বাচন হলে মথুরাপুরে এবার ফুটতেই পারে অন্যফুল। কুলপি ব্লক তৃণমূলের সভাপতি তারকনাথ প্রামাণিক বললেন, “সমস্যা আছে। তবে তার আঁচ নির্বাচনে লাগবে না।”
রাজ্যপাট হারালেও এখানকার মানুষের মধ্যে বাম-প্রভাব এখনও মুছে যায়নি। সিপিএম নেতা এক সময়ের সুন্দবন উন্নয়নমন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “মথুরাপুরের বিভিন্ন বিধানসভা কেন্দ্রে আমাদের অবদান রয়েছে। ২০১৪-র লোকসভায় এই কেন্দ্রের ৩৫ শতাংশ ভোট আমরা পেয়েছি। অবাধ নির্বাচন হলে আমরা ভাল ফল করব।” বাম প্রার্থী ডাঃ শরৎ হালদার ছাড়াও আছেন কংগ্রেস প্রার্থী কীর্তিবান সরদার। কথা বলার সুযোগ পেলেই নিজেদের ক্ষোভ উগরে দেন এখানকার মানুষ। অঞ্চলগুলিতে অশিক্ষার হার প্রবল। এ নিয়ে যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ। কিন্তু ভোট নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। ভোট দেবেন এটা জেনেই যে তাদের অন্ধকার ঘুচবে না। এই অব্যক্ত জ্বালা ইভিএমের মাধ্যমে ওরা কতটা মেটাবে, তার উপর নির্ভর করছে মথুরাপুরের ফল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.