Advertisement
Advertisement
Reincarnation

যেন রক্তমাংসের ‘মুকুল ধর’, পুনর্জন্ম নিয়ে নিজের খুনিদের ধরিয়ে দিয়েছিল ছোট্ট বালক!

সত্যিই কি জাতিস্মর ছিল টিটু সিং?

Strange case of Titu Singh, who claims he take reborn after being murdered। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:December 16, 2023 8:20 pm
  • Updated:December 16, 2023 8:34 pm  

বিশ্বদীপ দে: শীতের কনকনে রাতে উঠে এক ছোট্ট ছেলে বুঁদ হয়ে ছবি আঁকছে। আঁকছে ময়ূর, উট, যুদ্ধ এবং অবশ্যই সোনার কেল্লার ছবি। কোনও বাঙালিকে এর পর আর বলে দিতে হয় না মুকুল ধর নামের সেই আশ্চর্য জাতিস্মরের (Reincarnation) কথা বলা হচ্ছে। সত্যজিতের উপন্যাস ও ছবি এই বঙ্গদেশের নাবালক থেকে সাবালক সবাইকে আজও মজিয়ে রেখেছে। কিন্তু সত্যজিৎ (Satyajit Ray) আকাশ থেকে এই গল্প বুনে দেননি। সত্যি সত্যিই নিজেকে জাতিস্মর দাবি করা মানুষের অভাব নেই। বিখ্যাত হিন্দি ছবি ‘কর্জ’ কিংবা যে ছবি থেকে তা অনুপ্রাণিত বলে শোনা যায় সেই ‘দ্য রিইনকার্নেশন অফ পিটার প্রাউড’ তো বানানো গল্প। রক্তমাংসের বহু মানুষের দাবিই কিন্তু এই সব ছবি ও উপন্যাসের আসল অনুপ্রেরণা। আর সেই তালিকা থেকে টিটু সিংকে বাদ দেওয়া যায় কি? তার কাহিনি আজও চমকে দেয়। ভাবায়। স্তব্ধও করে দেয়। হার মানায় গল্পকথাকে।

সালটা ১৯৮৮। গোটা দেশ তোলপাড় হয়ে গেল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। এও কি সম্ভব? বছর পাঁচেকের এক ছোট্ট ছেলে দাবি করছে সে এক ব্যবসায়ী ছিল। মা-বাবার দেওয়া নাম টিটু সিং। অথচ তার দাবি সে সুরেশ ভার্মা। বিবাহিত। এবং তার দুই সন্তানও রয়েছে! তিন বছর বয়স থেকে সে এসব কথা বলে আসছে। কিন্তু এখন তার স্মৃতিতে যেন আরও নতুন নতুন ঘটনার কথা ফুটে উঠছে। কোনও শিশু নয়, বেশ পুরুষালি ভঙ্গিতে সে বলছে, ”আমি সুরেশ ভার্মা। আগ্রায় আমার রেডিওর দোকান। বউয়ের নাম উমা। আমাদের দুই সন্তানও রয়েছে। আমাকে খুন করা হয়েছিল।”

Advertisement
মুকুলকে বাঙালি কোনওদিন ভুলবে না

[আরও পড়ুন: সংসদে গ্যাস হামলার পরই কলকাতার NGO কর্মীকে ভিডিও পাঠায় ললিত! ঘনাচ্ছে রহস্য]

স্বাভাবিক ভাবেই এমন সব দাবি শুনে সকলে হতবাক। এসব কী বলছে ছোট্ট একরত্তি। নিজের মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত তার ঠোঁটস্থ। বাবা মহাবীর প্রসাদ ও মা শান্তিকে দেখিয়ে টিটু বলতে থাকে, ”এক রাতে বাড়ি ফিরছিলাম গাড়িতে। ফিরেও গিয়েছিলাম। বাড়ির সামনে পৌঁছে হর্ন দিচ্ছিলাম যাতে উমা এসে দরজা খুলে দেয়। কিন্তু তার আগেই অন্ধকার ভেদ করে উঠে আসা দুটো লোক গুলি করে আমার খুলি ফুঁড়ে দেয়।” সেই সঙ্গে নিজের এই জন্মের বাবা-মাকে দেখিয়ে টিটু ওরফে সুরেশ বলে ওঠে, ”এরা আমার কেউ নয়। আমার আসল মা বাবা আগ্রায় থাকে।” কেবল কথাই নয়, ছোট্ট ছেলেটার হাবভাব দেখেও অবাক হয়ে গিয়েছিল বাড়ির লোক। তিন বছর বয়স থেকেই সে সাংঘাতিক রাগী। ফুঁসতে ফুঁসতে কাপ-প্লেট ছুড়ে ফেলছে। চিৎকার করছে। ঠিক শিশুসুলভ নয় ব্যাপারটা। একটা ছোট্ট ছেলে সাধারণত বাড়ি মাতিয়ে রাখে। কিন্তু এক্ষেত্রে টিটু সিং বাড়ির লোকের ঘুম কেড়ে নিল।

কিছুতেই আর বিষয়টা স্বাভাবিক হল না। টিটুর বড় দাদা অশোক ঠিক করলেন তিনি এর সমাধান করবেন। তাঁদের বাড়ি থেকে আগ্রার (Agra) দূরত্ব ১৩ কিমি। সেখানে গিয়ে খোঁজখবর শুরু করলেন তিনি। আর থ হয়ে গেলেন। সত্যিই আগ্রার ব্যস্ত মল রোডে রয়েছে সুরেশ রেডিও শপ। সত্যিই সেখানকার মালিক সুরেশ ভার্মা খুন হয়েছিলেন! এবং বাড়ির সামনে আততায়ীদের গুলিতেই। তাঁর বিধবা স্ত্রীর নাম সত্যিই উমা। সন্তান দুই-ই। মাথা ঘুরে গেল অশোকের। এও সম্ভব? তিনি সুরেশের মা-বাবাকে নিয়ে এলেন তাঁদের গ্রামে। সঙ্গে উমা। অভিভাবকদের দেখতে পেয়েই টিটু দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। আর স্ত্রীর দিকে তাকাতে লাগল আশ্চর্য লাজুক ভঙ্গিতে।

টিটু সিং ও তার পরিবার

[আরও পড়ুন: বাড়ি থেকে পালিয়ে নমাজ পড়তে যাওয়া! ভিনরাজ্য থেকে ৯ নাবালককে উদ্ধার করল RPF]

শুনলে নেহাতই গল্পকথা মনে হতে পারে। কিন্তু সেই সময়ের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করা হয়েছিল। যে গাড়িতে সুরেশের পরিবারের সদস্যরা এসেছিলেন সেটা ছিল মারুতি। সেটা দেখে নাকি টিটুর প্রশ্ন ছিল, ”এই গাড়ি এনেছ কেন? আমার ফিয়াট গাড়িটা কই?” শুনে তে সকলে থ। সত্যিই যে সুরেশের ফিয়াট গাড়ি ছিল! আর সেই গাড়ি তাঁর মৃত্যুর পর বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।

চরম কৌতূহলে এর পর টিটুকে গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয় আগ্রা। নিজের দোকান নিজেই চিনতে পেরেছিল সে। স্বাভাবিক ভাবেই বিষয়টা ঘিরে হইহই শুরু হয়ে যায়। এর পরই ঘটনায় প্রবেশ করেন ‘ডক্টর হাজরা’। মানে, প্য়ারাসাইকোলজিস্ট। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এন কে চাড্ডা ও মার্কিন মুলুকের ড. এন্টনিয়া মিলস বি

‘কর্জ’ ছবিটিতে ঋষি তাঁর খুনের প্রতিশোধ নেন পরের জন্মে

ষয়টা নিয়ে তদন্ত শুরু করে দেন। আর চমকে ওঠেন। সুরেশের যেখানে গুলি লেগে, যেখান দিয়ে তা ফুঁড়ে বেরিয়েছিল অবিকল সেই দুই স্থানে দাগ রয়েছে টিটুর! যা এতদিন বাড়ির লোক জন্মদাগ বলেই ভেবে নিয়েছিলেন।

এমনও শোনা যায়, টিটু নাকি সুরেশের বাড়ির উলটো দিকের একটা বিরাট গাছ দেখিয়ে তার তলার মাটি খুঁড়তে বলেছিল। দাবি ছিল, সেখানে সে কিছু সোনার কয়েন পুঁতে রেখেছে! দেখা যায়, দাবি সত্যি। মাটির ভিতরে হলুদ ধাতুর মুদ্রা! এর পর টিটুর বাড়ির লোক তো বটেই, সুরেশের পরিবারও যেন মেনেই নেয় সুরেশ আর টিটু আসলে অভিন্ন আত্মা। একজনের মৃত্যু ১৯৮৩ সালের ২৮ আগস্ট। অন্যজনের জন্ম ওই বছরেরই ১০ ডিসেম্বর। টিটু জাতিস্মরই।

এখানেই শেষ নয়। শোনা যায়, টিটুর নাকি এও মনে পড়ে গিয়েছিল কোন ‘রাইভ্যাল’ ব্যবসায়ী তাকে গুলি করেছিল। সেই সাক্ষ্য থেকে মামলা গড়ায় আদালতে। পুলিশের জেরার মুখে নাকি অপরাধও স্বীকার করে নেয় অপরাধীরা। স্বাভাবিক ভাবেই এই ঘটনা সত্যিই অবিশ্বাস্য। কিন্তু পুরনো সংবাদমাধ্যমে টিটুর বিচিত্র ও অভূতপূর্ব সব ঘটনার কথা বিধৃত রয়েছে। ঘাঁটতে বসলে মুকুলকে মনে পড়বেই। সুরেশ পেরেছিল ‘দুষ্টু লোক’দের ধরিয়ে দিতে। যা সম্পূর্ণ করেছিল এক বৃত্ত। কিন্তু সেই সঙ্গেই মনখাপা লাগে উমার মন্তব্যের কথা জানলে। সংবাদমাধ্যমের সামনে সুরেশ জায়া বলেছিলেন, ”আমি নিঃসন্দেহ এ সুরেশই। কিন্তু আমার সঙ্গে তো ওর সেই সম্পর্ক আর ফিরবে না!” আত্মা যতই এক হোক, চেহারা আর বয়স যে একেবারেই ভিন্ন এক মানুষকে তুলে ধরছে! 

COVID-19 infection may affect grey matter of brain
পূর্বজন্মের স্মৃতি বলে কি সত্যিই কিছু থাকে?

দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে তিরিশ বছরেরও বেশি সময়। এখন কোথায় টিটু? সত্যিই কি তার জীবনের সব সত্য়ি? পুরনো সংবাদমাধ্যমে তার ছবি তো বটেই, পরিবারের সকলেরই ছবি ছাপা হয়েছিল। কিন্তু এখন সে বড় হয়েছে। কোথায় টিটু? সত্যিই খুঁজেও যেন তার হদিশ মেলে না। তবে কারও দাবি, টিটু বড় হয়ে এক অধ্যাপক হয়েছেন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি। ছোটবেলার ঝঞ্ঝার দিনগুলো পেরিয়ে এখন তিনি শান্ত, অন্তর্মুখী এক মানুষ। আবার এমনও দাবি, টিটু নাকি মনগড়া কথা বলেছিল।

সত্যিটা যে কি তা পরের দিনগুলোয় কেমন গিঁট পাকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এমন সব কথা যাঁরা আলোচনা করেন, এই নিয়ে চর্চা করেন, তাঁদের কাছে টিটু সিং আজও এক বিস্ময়ের নাম। আর যাঁরা সত্যি জীবন থেকে স্রেফ রোমাঞ্চ খুঁজে পেয়েই খুশি, তাঁরা অত কিছু না ভেবে ডুব দেন এক বালকের জীবনে, যে জীবন হার মানায় গল্পকথাকেও।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement