বিশ্বদীপ দে: সিরিয়াল কিলার (Serial Killer)। মাত্র দু’টি শব্দ। কিন্তু তা উচ্চারণ করলেই কত কিছু একসঙ্গে ভেসে ওঠে। জ্যাক দ্য রিপার থেকে হিচককের ‘সাইকো’ হয়ে হাল আমলে বাংলা ছবিতেও বারবার দেখা মিলেছে হাড়হিম সব খুনির। কেউ রুপোলি পর্দার চরিত্র। কেউ রক্তমাংসের। আবার জ্যাক দ্য রিপার রয়ে গিয়েছে মিথ ও বাস্তবের মধ্যবর্তী ধূসর এক এলাকার বাসিন্দা হয়ে। কিন্তু সিরিয়াল কিলারদের মধ্যে নানা রকমফের যতই থাকুক, এটা কি কল্পনাও করা যায় মাত্র বছর দশেকের এক বালকের মধ্যে মাথাচাড়া দিচ্ছে খুন-আমোদের গা ঘিনঘিনে এক নেশা! আসুন পরিচয় করা যাক অমরজিৎ সদার সঙ্গে। বিহারের (Bihar) এই ছোট্ট ছেলেটি আজও মনোবিদ ও সমাজবিদদের কাছে এক বিস্ময়ের খনি। এত অল্প বয়সে একে একে তিনটি শিশুকে মেরে ফেলেও যার মধ্যে অনুতাপের ছিটেফোঁটাও ছিল না। বরং খুনের কথা উঠলেই হেসে উঠতে দেখা গিয়েছিল তাকে।
হ্য়াঁ, এখনও পর্যন্ত যত সিরিয়াল কিলারের সন্ধান মিলেছে তাদের মধ্যে অন্যতম কনিষ্ঠ অমরজিৎ। যে বয়সে বাচ্চারা ঘুড়ি ওড়ায়, কমিকস পড়ে, টিভির পর্দায় কার্টুনে চোখ রাখে সেই বয়সে অমরজিৎ হয়ে দাঁড়িয়েছিল মূর্তিমান ত্রাস।
ঠিক কী করেছিল বেগুসরাইয়ের বাসিন্দা ওই ছোট্ট ছেলেটি? জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় দেড় দশক। ১৯৯৮ সালে জন্ম নেওয়া অমরজিৎ ১০ বছর বয়সে যখন ধরা পড়ে ততদিনে তিন-তিনটি খুন করে ফেলেছে সে। যাদের মধ্যে রয়েছে তার নিজের বোনও!
তার জীবনের প্রথম খুন সে করেছিল ৬ বছরের খুড়তুতো ভাইকে। তার কয়েক মাসের মধ্যেই নিজের আট মাসের ছোট্ট বোনকেও খুন করে অমরজিৎ। কিন্তু এই দুটো খুনের খবর পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছতে দেয়নি বাড়ির লোকই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশীদের ৬ মাসের সদ্যোজাত কন্যা খুশবুকে খুন করার পরে আর চেপে রাখা যায়নি সেই সংবাদ।
খুশবুর মা চুনচুন দেবী মেয়েকে পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুইয়ে রেখে এসেছিলেন। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন রোজকার কাজে। আর সেই ফাঁকে সকলের অগোচরে খুশবুকে সেখান থেকে তুলে এনে নৃশংস ভাবে খুন করে অমরজিৎ। ইট দিয়ে থেঁতলে থেঁতলে। তারপর দেহটা পুঁতে দেয় দূরে ক্ষেতের মাটিতে।
শিশুটির নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে তদন্ত শুরু করে। সেই সময়ই কানাঘুষো বেরিয়ে পড়ে, বছরখানেকের মধ্যেই গ্রামের এক পরিবারে দুটি বাচ্চা মারা গিয়েছে অস্বাভাবিক ভাবে। এবং আশপাশের লোকদের সন্দেহের তির অমরজিতের দিকেই। স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশ পাত্তা দিতে চায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়, তখনই তাদের অবাক করে দিয়ে নিজের অপরাধ কবুল করে নেয় ছেলেটি। কেবল তাই নয়। নিজেই পুলিশকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দেয় কোথায় সে পুঁতে রেখেছে খুশবুকে!
উপস্থিত পুলিশকর্মীরা কার্যতই থতমত খেয়ে গিয়েছিল অমরজিৎকে দেখে। ছেলেটা কথা বলে খুবই কম। কিন্তু হেসে ওঠে থেকে থেকেই। তার শূন্য দৃষ্টি ও অদ্ভুত ছমছমে হাসি দেখে তাদেরও গা শিউরে উঠেছিল।
অমরজিৎ সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য অবশ্য জানা যায় না। তার বয়সের কারণেই আদালত অধিকাংশ তথ্যই বাইরে আসতে দেয়নি। তবে এটা জানা গিয়েছিল, খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান অমরজিতের বাবা ছিলেন পেশায় শ্রমজীবী। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রের মুখে পড়েই কি তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল ঘৃণার মহীরুহ?
কেন করলে এরকম? এই প্রশ্নের উত্তরে পুলিশকে অমরজিৎ বলেছিল, ”ও স্কুলের ভিতরে ঘুমোচ্ছিল। আমি ওকে তুলে নিয়ে আসি। তারপর ইঁট দিয়ে ওকে থেঁতলে দিই।” কিন্তু কেন? এর উত্তর সেভাবে দিতে পারেনি সে। কেবল হেসেছিল। আর খিদে পেয়েছে জানিয়ে বিস্কুট খাওয়ার বায়না ধরেছিল। তার কাণ্ড দেখে সকলেই শিউরে ওঠেন।
মনে পড়ে যায় নরম্যান বেটসকে। অ্যান্টনি পার্কিন্সের অভিনয়ে আজও সাদা-কালো ‘সাইকো’র সেই ঠান্ডা মাথার খুনির চাহনি একবার দেখলে ভোলা যায় না। সঙ্গে সেই মিটমিটে হাসি। সেই হাসিই যেন ফুটে উঠতে দেখা গিয়েছে বাস্তবের অমরজিতের মুখে।
পাটনার বাসিন্দা মনোবিদ শামশাদ হুসেন এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে সেই সময় জানিয়েছিলেন, ওই বালক আসলে স্যাডিস্ট। আঘাত করে, মানুষকে কষ্ট দিয়েই তার আনন্দ। এই বিকৃতি এক গভীর মানসিক অসুখ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মনোবিদরা জানিয়েছেন, ছেলেটির মধ্যে অনুচিত-উচিত, ঠিক-ভুল জাতীয় কোনও বোধই তৈরি হয়নি। তাই নৃশংস খুনের পরেও তার মনের মধ্যে একচিলতে অপরাধবোধও জন্ম নেয় না।
তবে সারা পৃথিবীতে অমরজিৎ একা নয়। এই ধরনের নজির কম নেই। ১৯৯৩ সালে দেখা মিলেছিল জোন ভেনাবেলস ও রবার্ট থম্পসন নামের জোড়া সিরিয়াল কিলারের। দু’জনেরই বয়স ছিল ১০। একসঙ্গে মিলে তারা খুন করেছিল একটি ২ বছরের শিশুকে। এমন আরও আছে।
কিন্তু অমরজিৎ ব্যতিক্রম। তিন-তিনটে খুন করেও নির্বিকার থাকা এই ছেলেটিকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত হোমে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। ২০১৬ সালে সে মুক্তি পায়। এখন কোথায় আছে সে? তা অবশ্য জানা যায় না। তবে তার নাম এখনও ভেসে রয়েছে ভারতের অপরাধ জগতের এক ভয়ংকর মিথ হয়ে। পুলিশের সামনে নিজের অপরাধ কবুল করে যে হাসতে হাসতে বিস্কুট চেয়েছিল নির্বিকার চিত্তে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.