অস্টিন হারবিসন আর অ্যালেক্স হফপাইরের প্রেমের গল্প বোধহয় যুগ যুগ ধরে থেকে যাবে, শুধু একটি মুহূর্তবন্দির জন্য। আকাশে সূর্যের ‘ডায়মন্ড রিং’, সঙ্গী ভেনাস আর ধূমকেতু। তখন ঠিক তার নিচে যুগলের প্রপোজ মোমেন্ট এক ফ্রেমে বন্দি। যে ছবি সোমবার ইতিহাসের দীর্ঘতম পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণকে (Total solar eclipse) সাক্ষী রেখে ক্যামেরাবন্দি করেছেন তরুণী ফোটোগ্রাফার মেসি অ্যালেক্স। আর আমেরিকার টেক্সাসের ডালাস ফোর্ট ওয়ার্থ শহরের কাছে সেই মহাজাগতিক ঘটনার মুহূর্তে যুগলের প্রপোজ করার ছবি নিমেষে দুনিয়াজুড়ে ভাইরাল হয়েছে। আর যে ছবি একদিনের মধে্য মেসি অ্যালেক্সের পরিচিতি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। চাঞ্চল্যকর সেই ছবি দেখে আমজনতা প্রথমে ভেবেছিল এও কি সম্ভব, নাকি কোনও ফোটোশপের কারিকুরি। রহস্যভেদ করেছেন ফোটোগ্রাফি মহলের ‘মেসি’ মেসি অ্যালেক্সি। টেক্সাস থেকে জানালেন তিনি। কথা বললেন পার্থসারথি সিংহ।
প্রথম দেখা
সালটা ২০১৬। অ্যাস্টিন এবং অ্যালেক্সের দেখা হয় একটি ক্যাম্পে। সেখান থেকে বন্ধুত্ব। এরপর তিন বছরের ডেটিং। ডিজাইনার অ্যালেক্স আর পোষ্যদের খাবারের ব্যবসায়ী অস্টিন চাইতেন এমন একটা মুহূর্ত তঁাদের জীবনে আসুক, যেখান থেকে তঁারা শুরু করবেন নতুন জীবন। গত পঁাচ বছরে নানা সময় পেরিয়ে আসে দুর্বিষহ করোনা। তাই সুস্থ পৃথিবীর বুকে ভালোবাসার মুহূর্ত ধরে রাখতে অ্যালেক্স খুঁজতে থাকেন এমন একটি দিন, যেদিন বিয়ের প্রস্তাবে চমকে দেবেন অস্টিনকে।
মেসির খেঁাজে
গত মার্চে অ্যালেক্স হফপাইরে যোগাযোগ করেন ফোটোগ্রাফার মেসি অ্যালেক্সের সঙ্গে। বছর ৩২-এর এই তরুণী এক সময়ে ছিলেন এয়ারফোর্সের ফোটোগ্রাফার। বর্তমানে সেই কাজ ছেড়ে নিজের মতো ছবি তুলতে ব্যস্ত তিনি। তঁার ফ্রেমে বিভিন্ন যুগলের নানা বিশেষ মুহূর্ত ধরা পড়ে নয়া আঙ্গিকে। সেইমতো মেসি অ্যালেক্সের ইনবক্সে যোগাযোগ করেন হফপাইরে। নিজেও ডিজাইনার হওয়ার সুবাদে আগাম কিছু পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন এই যুবক। সেইমতো চলতে থাকে চক আউট।
যেমন কথা তেমনি কাজ
প্রপোজ মোমেন্ট। সূর্যগ্রহণ। হীরের আংটি থাকবে এক ফ্রেমে। এমনটাই চেয়েছিলেন অ্যালেক্স হফপাইরে। শুনেই চমকে উঠেছিলেন মেসি অ্যালেক্স। কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি। যুবকের পরিকল্পনা শুনে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন সেই বিশেষ জায়গা। সেখানেই মাত করেছেন মেসি। কীরকম? টেক্সাসের লুইসভিলের এই ফোটোগ্রাফার জানান, এমন একটি জায়গা চেয়েছিলাম যেখানে ওই যুগলকে আমি ক্যামেরার সাহাযে্য নিচ থেকে উপরের দিকে ধরতে পারব। আর তঁাদের মাথার উপর থাকবে সূর্যের সেই হীরের আংটি।
মুরেল পার্কে মেসি
টেক্সাসের ডালাস ফোর্ট ওয়ার্থ শহরের কাছে ফ্লাওয়ার মাউন্ডের মুরেল পার্ক। সেই জায়গাটি বেছে অ্যালেক্সকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ওই তরুণী ফোটোগ্রাফার মেসি অ্যালেক্স। কেন মুরেল পার্ক? তিনি বলেন, এই জায়গাটি শুটিং করার জন্য আমার প্রিয় জায়গাগুলির মধে্য একটি। ওই যুবককে জানিয়েছিলেন, প্রপোজের জন্য এটাই হবে আদর্শ স্থান। কারণ এই জায়গাটির পাশেই রয়েছে হ্রদ এবং খাঁড়া উঁচু এলাকা। এই পাহাড়ের উপর যুগলে দঁাড়াবেন। তাদের নিচেই মালভূমির ঢালে সেটআপ হবে ক্যামেরা। যাতে শটটি লাইনআপ করতে সুবিধা হয়। সেইমতো সোমবার দুটি ক্যামেরা, ট্রাইপড, ভিডিও রেকর্ডার, এনডি ফিল্টার-সহ নানা সরঞ্জাম নিয়ে নিচের দিকে দঁাড়িয়েছিলেন মেসি অ্যালেক্স। কারণ তিনি জানতেন, যখনই সূর্য ঢেকে আকাশ অন্ধকার হবে, তখনই একটি ফ্ল্যাশে ধরতে হবে মুহূর্তটি। মেসির কথায়, আমি এই দায়িত্বটি নেওয়ার পর থেকেই চিন্তায় ছিলাম। যেহেতু এরকম একটি ছোট্ট মুহূর্তের মধে্য প্রপোজ মোমেন্টটিকে ধরতে হবে, তাই মানসিক চাপও তৈরি হয়েছিল।
ঠিক দুপুরবেলা
মুরেলপার্কে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন যুগল অস্টিন আর অ্যালেক্স। বান্ধবী অস্টিনকে বুঝতে দেননি এমন একটা মুহূর্ত উপহার দেবেন অ্যালেক্স। তাই চোখে রোদচশমা পরে একটি লন চেয়ারে বসেছিলেন ফোটোগ্রাফার মেসি অ্যালেক্স। তঁার কথায়, গ্রহণ দেখার বিশেষ চশমাও সঙ্গে রাখতে হয়েছিল। আর সেটা চোখে দিয়েই আগাম মহড়া করেছিলেন তিনি। যাতে ক্যামেরা বা অন্যান্য সরঞ্জাম দেখে না ফেলেন অস্টিন তাই মোটা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল ফোটোগ্রাফির সরঞ্জামগুলি। এরপরই কিছুটা প্রতিবাদ করলেও তঁাকে বুঝিয়ে ছবি তোলার মুহূর্তের জন্য রাজি করান অ্যালেক্স। কিন্তু বলেননি, কী হতে চলেছে। কিন্তু যা হয়েছে, এখন তা ইতিহাস।
তখন ১.৪২ মিনিট
দুপুরে স্পেশাল লাঞ্চ দিয়ে শুরু হয়েছিল যুগলের বিশেষ মুহূর্ত। ঠিক মিনিট পঁাচেক আগে থেকে শুরু হল প্রস্তুতি। ক্যামেরা নিয়ে তৈরি টিম মেসি। ১টা ৪০ মিনিটে আস্তে আস্তে ঢাকছে সূর্য। হঁাটু মুড়ে অস্টিনের সামনে বসছেন অ্যালেক্স। চুম্বন। আলিঙ্গন। ঘড়িতে ১.৪২। আকাশে সূর্যের হীরের আংটি। হঁাটু মুড়ে অস্টিনের সামনে বসে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন অ্যালেক্স। আঙুলে পড়ালেন স্ট্যাগহেড ডিজাইনের নীলকান্ত মণির সেই রিং। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পারফেক্ট শট। একটি মহাজাগতিক মুহূর্ত। আর সেই মুহূর্তবন্দির জন্য মাত্র চার মিনিটের প্রস্তুতি। কীভাবে এক্সপোজার, পজিশন সেট করে শট পারফেক্ট করেছেন, তা এখন মেসি অ্যালেক্স বুঝছেন উত্তাল নেট দুনিয়া দেখে। যেখানে অভিনন্দনের বন্যা। প্রশংসা। বুধবার পর্যন্ত যে ছবি ৪ মিলিয়নেরও বেশি ভিউ হয়েছে। শেয়ার হয়েছে ঝড়ের গতিতে।
আনন্দে চোখে জল, আমি পেরেছি
শট পারফেক্ট বুঝেই মুরেল পার্কে চিৎকার করে উঠেছিলেন মেসি অ্যালেক্স। বললেন, শুটের পরই আমি বাড়ির দিকে ছুটেছিলাম। শুধু এইটুকুই বলেছি আমি পেরেছি। সেই মুহূর্ত চোখে জল এনে দিয়েছিল। এমনকী সামনে একটি রেস্তরঁার আমার ফোনটাও প্রায় ছুডে় ফেলে দিয়েছিলাম। এটি এমন একটি ঘটনা, আমি যা চেয়েছিলাম, তা-ই হয়েছে। চেয়েছিলাম অস্টিন আর অ্যালেক্সের জন্য। তঁাদের এই মুহূর্তটি যেন সতি্যই স্পেশাল হয়। আর হলও তাই। শুটের পর টিকটক, ছবি পোস্ট হওয়ার কয়েকঘণ্টা পর তিনি বুঝতে পারেন, তিনি কী ঘটিয়েছেন। সোশাল মিডিয়ায় শুভেচ্ছার বন্যায় আপ্লুত মেসি বলেন, আমি চিরকাল তঁাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব, যঁারা আমার ছবি নিয়ে আমার মতোই উত্তেজিত এবং ভালোবাসা জানিয়েছেন। এই মুহূর্তটি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার আনন্দই আলাদা। আমি চাই, অমর এই ছবিতে বন্দি থাক ওদের অমর প্রেম।
আর হ্যাঁ, অস্টিন অ্যালেক্সের প্রস্তাবেও সাড়া দিয়েছেন। বলেছেন, ‘ইয়েস’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.