সুমন করাতি, হুগলি: ‘জগৎটা আকারের মহাযাত্রা’, প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ কবিতার মতোই ছবিতে মশগুল হওয়ার পর একথাই লিখেছিলেন নির্মলকুমারী মহলানবিশকে। জীবনের ঘূর্ণিপাকে আটকেও ছবির মাধ্যমেই হুগলির যুবক সুমন মোদকও বিশ্বকে দেখছেন ‘আকারের মহাযাত্রা’ হিসাবে।
হুগলির (Hoogly) উত্তরপাড়া বাজার এলাকা। দিনের ব্যস্ত সময়। মুদিখানা দোকানে দক্ষতার সঙ্গে চাল-ডাল মাপছেন এক যুবক। দোকান ভর্তি মালপত্রের মাঝেই নজর কাড়ছে বেশ কিছু পোর্ট্রেট বা মুখাবয়বের ছবি। ফ্যানের হাওয়ায় ওড়া ছবিগুলো দেখে মনে হতে পারে তা বাজার থেকে কেনা। না, ছবিগুলি আঁকা বাটখারা তোলা ওই কর্মব্যস্ত হাতেরই। মুদির দোকানে বসেই একের পর এক ছবি এঁকে চলেছেন সুমন। সেই ছবিতে লুকিয়ে রয়েছে সংসারের দায়বদ্ধতা, পাশাপাশি নিজের শিল্প সত্ত্বাকে বাঁচানোর লড়াইও।
ছেলেবেলা থেকেই আঁকার প্রতি প্রবল ঝোঁক সুমনের। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে এমন শখ বিলাসিতা ছাড়া কিছু না! আর পাঁচটা পরিবারের মতো সুমনের বাবা-মাও চাইতেন, ছেলে পড়াশোনার পর চাকরি করে সংসারের হাল ধরুক। ছবি আঁকার জন্য পড়াশোনায় ক্ষতি হবে, সেই নিয়ে বাড়িতে ঝামেলাও হয়েছিল বিস্তর। এক সময় বাড়ির কঠিন নির্দেশেই তাঁকে ছাড়তে হয়েছিল ছবি আঁকা। এর পরে সময় গড়িয়েছে। কিশোর থেকে যুবক সুমন আজ মুদির দোকান চালান।
দোকান সামলেও পুরনো সেই ছবি আঁকার ইচ্ছা আবার জাঁকিয়ে বসেছে তাঁর মধ্যে। এখন কিন্তু তাঁকে আটকানোর কেউ নেই। সিনে দুনিয়ার সুপার স্টার থেকে, ক্রিকেট জগতের তারকা কিংবা বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী… সকলেরই পোর্ট্রেট আঁকেন তিনি। পাঁচশো থেকে শুরু করে হাজার টাকায় ছবি বিক্রি হয়েছে তাঁর দোকান থেকেই। শুধু তাই নয়, খুলেছেন আঁকার স্কুলও। সেখানে বিনামূল্যে আঁকা শেখান তিনি।
সুমনের কথায়, গ্রাজুয়েশন পাস করে অনেকবার চাকরির চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সুফল মেলেনি। লকডাউনের (Lockdown) সময় আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় দোকানে বসার সিদ্ধান্ত নেন। সঙ্গে চলতে থাকে ছবি আঁকা। আস্তে আস্তে দু’একটা ছবি দোকানের বাইরে বিক্রির জন্য রাখতে শুরু করেন। তাঁর হাতে আঁকা ছবি মানুষের এতটাই পছন্দ হয় যে তা কিনতে শুরু করেন এলাকার বাসিন্দারাও। এমনকী বাইরে থেকেও আঁকার জন্য ডাক আসছে।
এই বিষয়ে তাঁর বাবা গৌতম মোদক বলেন, “পারিবারিক ব্যবসা এখন ছেলের উপরেই। ওঁর ছবি আঁকাতে পরে আর বাধা দিইনি। দোকানে বসেই ছবি আঁকে। সেই ছবি বিক্রি হয় ভালো দামেই। এখন আঁকার একটি স্কুল খুলেছে। কিছু সময় তো বাইরের রাজ্য থেকেও ছবির কাজের ডাক আসে।” সংসারে চালাতে মুদিখানার দোকানের সঙ্গে চলছে স্বপ্নের চারকোল সেডের পোর্ট্রেট স্কেচ। রবীন্দ্রনাথের কথা আঁকড়ে সুমনও যেন বলছেন, ‘ঐগুলি কেবল রেখাই নয়, ঐগুলি তার থেকেও কিছু বেশি। আমার চিত্রাঙ্কিত স্বপ্ন, এক কাব্যিক কল্পনার দর্শন।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.