বিশ্বদীপ দে: ‘ডোবার থেকে ত্রিশ হাত দূরে বড় বাঁশঝাড়টা পেরোতেই তিনি জিনিসটা দেখতে পেলেন। একটা অতিকায় উপুড়-করা কাচের বাটির মতো জিনিস সমস্ত ডোবাটাকে আচ্ছাদন করে পড়ে আছে…’। গল্পের নাম ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’। ১৯৬১ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত সত্যজিতের (Satyajit Ray) এই গল্পে কাঁকুড়গাছিতে নেমে এসেছিল UFO। অন্য গ্রহের আগন্তুকের মহাকাশযান। এর ঠিক ১৪ বছর আগে ১৯৪৭ সালে আমেরিকার (US) রোজওয়েল (Roswell) অঞ্চলে প্রথমবার ভেসে উঠেছিল অজানা উড়ন্ত বস্তুর ধ্বংসাবশেষ মেলার দাবি। তারপর থেকেই গোটা বিশ্বে ক্রমশ বাড়তে থাকে ফ্লাইং সসার দেখার দাবিদারদের সংখ্যা। সেই ইতিহাসকে মনে রেখেই এই দিনে পালিত হয় বিশ্ব ইউএফও দিবস।
১৯৪৭ সালের ২ জুলাইয়ের রোজওয়েল দুর্ঘটনার বর্ষপূর্তি। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গিয়েছে ৭৪ বছর। আজও রহস্যে ঘেরা সেই দুর্ঘটনা। ঠিক কী ঘটেছিল? মনে রাখতে হবে, সে এক অদ্ভুত সময়। সদ্য শেষ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের দগদগে ঘা পৃথিবীর শরীর জুড়ে। আমেরিকাও ব্যতিক্রম নয়। উলটে সোভিয়েতের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধের শুরুয়াৎ হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় মার্কিন বায়ুসেনার তরফে আচমকাই এক আজব প্রেস রিলিজ পেশ করা হল। তাতে পরিষ্কার দাবি, তারা একটা ‘উড়ন্ত চাকি’ উদ্ধার করেছে!
এমন নয়, আমেরিকায় ইউএফও কথাটা সেই প্রথম উচ্চারিত হল। এর আগে বহুবারই আকাশে রহস্যময় আলো দেখার নানা দাবি শোনা গিয়েছে। কিন্তু এই প্রথম ভিনগ্রহীদের যানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের কথা শোনা গেল। তাও খোদ মার্কিন সেনার মুখেই। এমন খবরের জন্যই তো মুখিয়ে থাকে মিডিয়া। পরের দিনে ‘রোজওয়েল ডেইলি’ সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপা হল সেই খবর। রাতারাতি হইচই কেমন পড়ল, কল্পনা করা কঠিন নয়। কিন্তু এরপরই আচমকা একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল মার্কিন সেনা। পরিষ্কার জানিয়ে দিল, সকলের বুঝতে ভুল হয়েছে। ওসব ফ্লাইং সসার-টসার কিচ্ছু নয়। ওটা আসলে আবহাওয়া বেলুন। সেটাই ভেঙে পড়েছে। প্রমাণ হিসেবে বেলুন ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রের টুকরো সমেত মেজর মার্সেলের ছবিও ছাপা হল।
কিন্তু সেসব দাবিতে আর কে কান দেয়। বিশেষ করে যারা ভিনগ্রহীদের অস্তিত্বে প্রবল ভাবে বিশ্বাস করে। ফলে দশকের পর দশক পেরিয়ে গেলেও অন্যান্য জনপ্রিয় ইউএফও ‘মিথ’-এর অন্যতম হয়ে রয়ে গিয়েছে রোজওয়েল। ক্রমশই তার অস্তিত্বের সঙ্গে পেঁচিয়ে গিয়েছে অন্তরীক্ষের অনন্ত অজানা প্রদেশ থেকে ভেসে আশা রহস্যময় চাকতির ছায়া। গড়ে উঠেছে ইউএফও মিউজিয়াম ও রিসার্চ সেন্টার। এমনকী শহরের রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে আপনি দেখতে পাবেন ‘এলিয়েন’ থিমের স্ট্রিটলাইটও।
অবশ্য অন্যান্য মতও রয়েছে। ওটা মোটেই ভিনগ্রহীদের যান নয়। সোভিয়েতদের গুপ্তচর আকাশযান। চেপে যেতেই অন্য খিয়োরি খাড়া করা হচ্ছে। ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ আর নেই। তাই আজকাল আরও নতুন নতুন দাবি উঠে আসতে দেখা যায়। বলাই বাহুল্য, সেগুলি ধোপে টেকেনি। আর যদি জনশ্রুতির কথাই ধরা যায়, ইউএফও-র রোমাঞ্চকে ছেড়ে মানুষ আর সেসবে কান দিতে চায়নি।
তবে ১৯৯৪ সালে মার্কিন বায়ুসেনাই এক রিপোর্ট পেশ করে দাবি করে বেলুনের ব্যাপারটা নেহাতই ‘গল্প’। সেটা ছিল এক ‘প্রোজেক্ট মোগুল’ নামে গোপন মার্কিন প্রকল্পের অন্তর্গত ‘স্পাই ডিভাইস’। প্রাথমিক ভাবে সেটা থেকে লোকের নজর ঘোরাতেই ফ্লাইং সসারের রটনাকে সত্যি বলে মেনে নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু এই তত্ত্বকে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন ডোনাল্ড স্কিমিট। তাঁর সহজ যুক্তি, রোজওয়েলের খুব কাছেই লস আলামোস-এর পারমাণবিক গবেষণা সংস্থা। সেখানে তখন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চলছে। সঙ্গে জার্মানির ভি-২ রকেট নিয়েও নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। এই অবস্থায় রোজওয়েলে ইউএফও নিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে গুজব রটিয়ে ভিড় বাড়াতে চাওয়ার ব্যাপারটা নেহাতই অবিশ্বাস্য। তাঁর সাফ যুক্তি, ‘‘ওই সময় কি ওরা পাবলিসিটি করতে চাইবে? বরং উলটোটাই। ভিড় কমানোর উদ্দেশ্যই থাকার কথা।’’
প্রসঙ্গত, রোজওয়েলের ঘটনায় আরও নানা রোমাঞ্চকর দাবি উঠেছে। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি তো রীতিমতো চমকপ্রদ। তাঁরা জানিয়েছেন, কেবল ইউএফও নয়, ভিতরে থাকা মৃত এলিয়েনদেরও দেখেছেন তাঁরা! অনেক পরে ১৯৯৭ সালে এক রিপোর্টে সেই দাবির বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে মার্কিন সেনাদের তরফে বলা হয়, আসলে ওই বেলুনে রাখা ছিল ডামি। তাদেরই দূর থেকে দেখে ভিনগ্রহী বলে মনে করা হয়েছিল।
এভাবেই দাবি ও পালটা যুক্তির নানা প্যাঁচ পয়জারে পেরিয়ে গিয়েছে দশকের পর দশক। ঠিক যেমন আশ্চর্য রহস্যে মোড়া পশ্চিম আমেরিকার নেভাদা মরুভূমির ‘এরিয়া ৫১’। বলা হয়, ওই গোপন আস্তানায় নাকি রোজওয়েল দুর্ঘটনায় উদ্ধার হওয়া ইউএফও ও এলিয়েনের মৃতদেহ সংরক্ষণ করে রেখে তার উপরে গবেষণা চালানো হয়। আজও এই সব রহস্যের গায়ে পুরু মেঘের আস্তরণ এতটুকু সরেনি। সারা পৃথিবীর মধ্যে বোধহয় আমেরিকাতেই সবচেয়ে বেশি ভিনগ্রহীদের যান দেখতে পাওয়ার দাবি শোনা গিয়েছে।
একেবারে সম্প্রতি মার্কিন যুদ্ধবিমানের পাইলটদের UFO দর্শন নিয়ে প্রকাশিত সরকারি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, যতই নানা দাবি উঠুক। কিংবা ছবি মায় ভিডিও পর্যন্ত প্রকাশিত হোক, তবুও সেগুলি আসলে কী তা আজও অজানাই রয়ে গিয়েছে।
এই অবস্থায় আবার আরেকটা বিশ্ব ইউএফও দিবস। এই দিনটার উপলক্ষই হল একসঙ্গে সকলে মিলে রাতের আকাশের দিকে একবার চোখ রাখা। খুঁজে বেড়ানো পৃথিবীর দোসরকে। মহাবিশ্বে মানুষ কি নিঃসঙ্গই? উত্তর আজও মেলেনি। কেবল কল্পনার আকাশে ইউএফও নামতে দেখেছে কত একলা রাতের পথিক। মনে করা যাক ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের ‘অজানা উড়ন্ত বস্তু’ গানের এক অমোঘ পঙক্তিকে, ‘শহর আলোয় উজল/ ধোঁয়াশায় আকাশ পিছল/ ছাদে এসে নামে/ ভীনগ্রহী ফ্লাইং সসার’। সত্যিই কি তারা আসে? দোসরের সন্ধানে? প্রশ্নগুলো সহজ নয়। উত্তর আজও অজানাই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু রোমাঞ্চপ্রিয় মন ভাবতে ভালবাসে, একদিন না একদিন তারা আসবেই। দেখা হয়ে যাবে ঠিক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.