বিশ্বদীপ দে: অজানা রহস্যের কুয়াশা সভ্যতার গোড়া থেকেই ছড়িয়ে রয়েছে মানুষের মনে। কত রকমের কিংবদন্তি! বারমুডা ট্র্য়ায়াঙ্গেল হোক বা লকনেস মনস্টার, কিংবা মার্কিন মুলুকের মথম্যান… তালিকা করতে বসলে হাজারো নাম আসবে। কিন্তু সেই তালিকায় একটা নাম হয়তো থাকবেই- ইয়েতি! আসলে মানুষের মনের মধ্যে বরাবরই রয়েছে রোমাঞ্চের প্রতি অদম্য আকর্ষণ। কেবল ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর রুকুই নয়। আমরা সকলেই বিশ্বাস করতে চাই, সব সত্যি। অরণ্যদেব সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি, ডাকু গন্ডারিয়া সত্যি। এবং ইয়েতি তথা অ্যাবোমিনেবল স্নোম্যান, সেও সত্যি! ‘ক্রিপ্টোজুলজি’ নামের একটা বিষয় রয়েছে, সেখানে নানা বিচিত্র প্রাণীদের সম্পর্কে চর্চা করা হয়। সেখানে বিগফুট, লকনেস মনস্টার, চুপাক্যাব্রা, জার্সি ডেভিল নানা প্রাণীর দেখা মেলে। এবং অবশ্যই ইয়েতিও সেখানে রয়েছে। তবে সে না হয় মনের কোণে থাকা মিথের রোমাঞ্চ। বাস্তবে ব্যাপারটা কী? ইয়েতি আছে না নেই? যদি নাই থাকে, তাহলে এত বছর ধরে কেন টিকে রয়েছে সেই মিথ? কোথা থেকে তা জন্ম নিল?
ইয়েতি থাক বা না থাক, তার একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খোদ আলেকজান্ডার ইয়েতির কথা জানতেন। সেটা ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। জানা যায়, এদেশে এসে ইয়েতির কথা জানতে পেরে তিনি নাকি রহস্যময় প্রাণীটিকে দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তবে শেষপর্যন্ত তিনি আদৌ তা দেখেছিলেন, তেমন কোনও প্রমাণ অবশ্য নেই। ড্যানিশ লেখক এইচ সিগারের মতে, হিমালয়ের (Himalaya) বাসিন্দাদের মধ্যে ইয়েতির প্রতি বিশ্বাস বহু যুগের। সাম্প্রতিক অতীত, তাও প্রায় দুশো বছর আগের কথা, ১৮৩২ সালে জেমস প্রিন্সেপের লেখা ‘জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল’ বইটিতে উল্লেখ রয়েছে লম্বা কালো চুলের দীর্ঘাকায় দ্বিপদী প্রাণীর কথা। পরবর্তী সময়ও পর্বত অভিযাত্রীরা অনেক উঁচুতে বরফে ঘেরা প্রতিকূল পরিবেশে চকিতের জন্য দীর্ঘদেহী মানুষের মতো প্রাণী দেখেছেন। দ্রুত সেটি মিলিয়ে গিয়েছে শীতল অন্ধকারে।
১৯৫১ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিযাত্রী এরিক শিপটন দাবি করেন, তিনি এভারেস্টে ওঠার বিকল্প পথ অনুসন্ধান করার সময় বরফে দীর্ঘ পায়ের ছাপ দেখেছেন। কেবল দাবি করাই নয়, তিনি ছবিও তুলে আনেন। দেখা যায়, ওই ছাপ ১৩ ইঞ্চি লম্বা! বলতে গেলে সেই ঘটনাটিই সারা পৃথিবী ইয়েতির কথা ছড়িয়ে দিল। কেননা সেই প্রথম লেন্সবন্দি হল ইয়েতির পায়ের ছাপ! সেই শুরু। এর দুবছর পর তেনজিং নোরগে ও স্যার এডমন্ড হিলারি দাবি করলেন তাঁরাও এভারেস্টে ওঠার সময় বড় পায়ের ছাপ দেখেছেন। যদিও হিলারি পরে বলেছিলেন, ইয়েতি বলে কোনও প্রাণীর অস্তিত্ব বিশ্বাসযোগ্য নয়। আবার তেনজিং আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, তাঁর মতে, ইয়েতি আসলে বিরাট বাঁদর। তিনি না দেখলেও তাঁর বাবা দুবার এমন দীর্ঘ প্রাণী দেখেছেন। দ্বিতীয় আত্মজীবনীতে অবশ্য অন্য কথা লেখেন তেনজিং। জানিয়ে দেন, ইয়েতির অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান তিনি।
কিন্তু এহেন দোলাচলের মধ্যেই ওই পাঁচের দশক থেকেই ইয়েতি লেজেন্ড গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বহু দেশ থেকে অ্যাডভেঞ্চারিস্ট মানুষরা ছুটে এসেছেন হিমালয়ে, ইয়েতি দেখতে। নেপাল সরকার ইস্যু করতে থাকে ইয়েতি হান্টিং লাইসেন্স! যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছিল, ইয়েতির ছবি তোলা যেতে পারে বা তাকে বন্দিও করা যাবে। কিন্তু আত্মরক্ষার প্রয়োজন না পড়লে তাকে হত্যা করা যাবে না। আর যত ছবি তোলা হবে এবং কোনও ইয়েতির দেহ অথবা জ্যান্ত ধরতে পারলে তাকে নেপাল সরকারে কাছেই জমা দিতে হবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, ইয়েতির সন্ধান মিললে সেই সব প্রমাণ আগে প্রশাসনের কাছে জমা দিতে হবে। নিজেরা কলার তুলে সংবাদমাধ্যমকে ডেকে বললে হবে না। নিঃসন্দেহে কড়া শর্ত! বলাই বাহুল্য, লাইসেন্স দেওয়াই সার! ইয়েতির (Yeti) টিকির সন্ধানও মেলেনি।
এখানে একটা কথা বলাই যায়। একটা পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, স্কটল্যান্ড লকনেস মনস্টারকে (জলের ভিতর থেকে মাথা তোলা দীর্ঘদেহী প্রাণী যাকে দেখতে অনেকটাই ডাইনোসরের মতো) ঘিরে তৈরি হওয়া ট্যুরিজম থেকে বছরে ৬০ মিলিয়ন ডলার রোজগার করে। নেপাল কত উপার্জন করে, তেমন কোনও হিসেব মেলেনি। কিন্তু এবিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে বছরে একটা রোজগার তাদের নিশ্চিত ভাবেই হয়। কিন্তু ইয়েতি আজও কেবলই রহস্যে ঢাকা মিথের ভিতরে মুখ লুকিয়ে বসে রয়েছে।
তবু গত সাত দশকে ইয়েতি ফিরে ফিরে এসেছে যেন! এই কদিন আগে কয়েকজন বাঙালি অভিযাত্রী ক্যাম্প ওয়ান থেকে ক্যাম্প টুতে যাওয়ার সময় বরফের উপরে বড় বড় পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন। সাড়ে সাত ইঞ্চি লম্বা ও সাড়ে ছয় ইঞ্চি চওড়া সেই পায়ের ছাপের ছবিও তুলে এনেছেন তাঁরা। এর পর থেকে ফেরে বাঙালির আড্ডায় আরও একবার নতুন করে উঁকি দিতে শুরু করেছে ইয়েতি। আসলে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা যারা পড়েছে তাদের কাছে ইয়েতির এক অন্য আকর্ষণ রয়েছে। টেনিদা বলেছিল, ”…আসল ইয়েতি। তাকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করতে যাসনি… মারা পড়ে যাবি। আর তাকে কখনও দেখতেও চাসনি। না দেখলেই বরং ভালো থাকবি।” আবার টিনটিনের একটা গোটা কমিক্সই রয়েছে ইয়েতি নিয়ে। সেই কমিক্স কত কৈশোরকে যে রোমাঞ্চের কুয়াশামাখা পথের সন্ধান দিয়েছে…!
তবে ইয়েতি নিয়ে কিন্তু ‘সিরিয়াস’ গবেষণাও হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জিনতত্ত্বের অধ্যাপক ব্রায়ান সাইকস হিমালয়ের তুষারে উদ্ধার হওয়া চুল বা লোম নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করেছেন। তাঁর দাবি, তুষারমানব-টানব কিস্যু নয়। ওটা নিছকই কোনও মেরুভালুকের। তবে তারা বহু হাজার বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত। কিন্তু পৃথিবীর ‘ফ্রিজে’ অক্ষত রয়ে গিয়েছে আজও। আর তাকে নিয়েই তৈরি হয়ে গিয়েছে রহস্যঘন মিথ! যদিও পরে অন্য বিজ্ঞানীরা বলেন, মোটেই কোনও আদিম পৃথিবীর প্রাণীর নয়, ওই লোম আজকের পৃথিবীর সাধারণ মেরুভালুকের। তবে যাই হোক, লোমগুলি যে ভালুকের তাতে তাঁরা নিঃসন্দেহ। লেঙ্গুর থেকে তিব্বতি নীল ভালুক… আরও নানা মত রয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে ইয়েতি থাকুক বা না থাকুক, তাকে ঘিরে অনুসন্ধান চলেছে আজও। আর সন্ধান মিলুক না মিলুক, মনের গভীরে যাদের বাস তাদের চর্মচক্ষে না দেখলেও যে চলে সে কথা তো বলা অনর্থক। এই লেখার শুরুতেই বলা কথাগুলোই বলতে ইচ্ছে করে। অরণ্যদেব সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি, ডাকু গন্ডারিয়া সত্যি… ইয়েতিও…
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.