সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: চারপাশে ঝোপঝাড়। তারই মধ্যে লতাপাতা জড়ানো একটা পুরনো বাড়ি। সেই বাড়ির দেওয়াল ভরতি শ্যাওলা। বাড়ির ছাদেও দিব্যি শেকড় গজিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একগুচ্ছ বনজঙ্গল। ভবনের একপাশে লোহার দরজা–জানালা। দিনের বেলাতেও গা ছমছম করে ওঠে। শরীরে কাঁটা দেয়। এ বাড়ি দেখলে ‘ভূতুড়ে বাড়ি’ ছাড়া অন্য কিচ্ছু মনে হয় না। কিন্তু এই ‘ভূতুড়ে বাড়ি’তেই দীর্ঘদিন ধরে চলছে টাউন লাইব্রেরি। পুরুলিয়ার ঝালদা শহরে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারটি এভাবেই পেরিয়ে এসেছে তিন দশক।
জ্ঞান বৃদ্ধির জন্যই তো মানুষ লাইব্রেরিতে ছোটেন। কিন্তু যেখানে জ্ঞান আহরণের জন্য যাবেন, সেই জায়গার দেখেই যদি এমন অশরীরীর অনুভূতি হয়, তাহলে পড়াশোনায় মন দেওয়া কঠিন হয় বইকি। ঝালদার সরকারি গ্রন্থাগারটি ঠিক তেমনই। যে কোনও সময় এই পোড়োবাড়ির কোনও অংশ ভেঙে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ঘরের ভেতরে মাঝেমধ্যেই চাঙড় খসে পড়ছে। ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গ্রন্থাগারে থাকা মূল্যবান বই। ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে ওই লাইব্রেরিতে থাকা তিনটি কম্পিউটর ও একটি জেরক্স মেশিন।
আগে পাঠকদের বই দেওয়ানেওয়ার বিষয়টি কম্পিউটরের মাধ্যমেই নথিভুক্ত করা হত। কিন্তু ছাদ চুঁইয়ে বৃষ্টির জল পড়তে থাকায় ওই কম্পিউটরগুলি খারাপ হয়ে যায়, অকেজো হয়ে যায় জেরক্স মেশিনও। ‘ভূতুড়ে বাড়ি’র লাইব্রেরিতে স্থায়ী কোনও গ্রন্থাগারিকও নেই। বেগুনকোদর গ্রামীণ লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক মথুর কুমার সপ্তাহে দু’দিন সোম ও বুধবার এই টাউন লাইব্রেরিতে এসে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করেন। তাছাড়া সহকারী গ্রন্থাগারিকও পদও খালি পড়ে আছে। নেই নৈশপ্রহরীও। পিওন ও বই বাঁধাইয়ের কর্মীরা অন্য দিনগুলিতে পাঠকদের বই দিয়ে থাকেন। স্থানীয় গ্রন্থাগার কৃত্যকের চেয়ারম্যান তথা পুরুলিয়ার জেলাশাসক রাহুল মজুমদার বলেন, “বিষয়টি দেখা হচ্ছে। পাঠকদের যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তা দেখছি।”
এই ভবনটি পুরুলিয়া জেলা পরিষদের। একসময়ে ১৫ টাকা ভাড়ায় এই গ্রন্থাগার চলত। এখন আর অবশ্য কোনও ভাড়া লাগে না। বর্তমানে এই গ্রন্থাগারে ১৫ হাজার বই রয়েছে। কিন্তু সেসব মূল্যবান বই কতদিন সযত্নে আগলে রাখা যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ অনেকেরই। এখানকার গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বে থাকা মথুর কুমার বলেন, “যাতে এই গ্রন্থাগারকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যায়, সেই চেষ্টা চলছে। এই বিষয়ে আমি ঝালদা মহকুমা শাসককে বলেছি।”
ঝালদা মহকুমা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, বাঘমুন্ডি রোডে এই লাইব্রেরির জন্য ৬ ডেসিমেল জমি চিহ্নিত হয়েছে। জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক মার্শাল টুডুর কথায়, “এখনও ওই জমিটি হস্তান্তর হয়নি। বিষয়টি জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের আধিকারিকের অধীনে রয়েছে।” ওই বুক বাইন্ডার তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “কী করব? স্থায়ী গ্রন্থাগারিক নেই, তাই সব কাজ আমাকেই করতে হয়। তার মধ্যেই চেষ্টা করি, পাঠকদের যাতে কোনও সমস্যা না হয়।” কিন্তু সমস্যা তো হচ্ছেই। হয়ত দিনে দিনে তা আরও বাড়বে। কোনদিন হয়ত সত্যিই এখানে মানুষজনের উপস্থিতির বদলে টের পাওয়া যাবে অশরীরীদের আনাগোনা!
ছবি: অমিত সিং দেও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.