ঘরের পোকা মাকড়ের উৎপাত চোখের সামনেই নিয়ত ঘটে। তবুও চোখ এড়িয়ে যায় বিপদ সংকেত। সতর্ক করলেন আর জি কর হসপিটালের পয়জন এক্সপার্ট ডা. সোমনাথ দাস ও বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু ঝা। মুখোমুখি জিনিয়া সরকার।
এমন কি হয় না? রান্না করে টেস্টি খাবার ডাইনিং টেবিলে রাখতে না রাখতেই পিঁপড়ের আনাগোনা, রান্নাঘরের তাকে কৌটো করে সুন্দর সাজিয়ে রাখা মুখোরোচক খাবারে আরশোলার রাজত্ব। খাদ্যবস্তুকে ফ্রিজ বন্দি করে রাখলেও নিস্তার নেই পোকার হাত থেকে। আতঙ্ক, যদি কোনও পোকামাকড় পড়ে যায় খাবারে কিংবা কিছু যদি চেটে দিয়ে যায়! শত চেষ্টা করে, নানাভাবে খাবার ঢেকে রেখেও ঘরের পোকা-মাকড় থেকে খাবারকে বাঁচিয়ে রাখা যেন এক যুদ্ধ। এদিকে মায়ার বশে খাবারে অল্প-বিস্তর পোকা পড়লে বা পিঁপড়ে ধরলে তা ঝেড়ে ফেলে টপ করে মুখে। আর চোখে না পড়লে তো কথাই নেই। সবই ভাল। খাদ্যবস্তুর উপরে চোখের আড়ালে ঘটে যাওয়া পোকা ও কীটের আক্রমণ তো অতি উহ্য বিষয়। বাইরে থেকে রাসায়নিক কীভাবে খাবারকে বিষাক্ত করছে সে নিয়ে যেটুকু চিন্তিত বা এ বিষয় যতটা আলোচিত সে তুলনায় পোকা-মাকড় দ্বারা খাবারে বাহিত বিষক্রিয়া নিয়ে মাথাব্যথা প্রায় নেই-ই। কিন্তু এই ছোট ছোট ঘটনাই খাবারে বিষক্রিয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হতে পারে।
কী কী ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি
- বিভিন্ন পোকামাকড় খাবারে পড়ে গিয়ে তার শরীরের টুকরো অথবা তার মল সরাসরি খাদ্যদ্রব্যে মিশে যায় যা মারাত্মক ক্ষতি করে।
- গুদামে খাদ্যদ্রব্য থাকার সময় চালে, গমে কিছু পোকা জন্মায়। সাধারণত বাড়িতে রোদে দিয়ে দানাশস্যগুলি শুকিয়ে নিয়ে এই পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু সরকারি বা কোন বড় গুদামে রাখা দানাগুলি এসব ভালভাবে না করেই হয় তা ব্যবহারের জন্য বণ্টন করা হয় অথবা তা ভাঙানো হয়। সেক্ষেত্রে যখন গম থেকে আটা বা ডাল ভাঙিয়ে ছাতু তৈরি হয় করা হয় তখন এই পোকামাকড় বা তার শরীরের নানা অংশ এর মধ্যে মিশে খাবার বিষাক্ত হতে পারে।
- অন্যদিকে খোলা জায়গায় বাসন বা বিভিন্ন খাবারের পাত্র, জলের বোতল ইত্যাদি না ধুয়ে ব্যবহার করলে এই ধরনের পোকামাকড় থেকে নানা বিষাক্ত উপাদান শরীরে প্রবেশ করে ও রোগ ছড়ায়। সবচেয়ে বিপজ্জনক উদাহরণ হল মাছি বা হাউস ফ্লাই। এছাড়া রয়েছে ইঁদুর, পাখি, পিঁপড়ে, আরশোলা ও অন্যান্য পোকামাকড়। বিশেষ করে রাত্রিবেলা যখন সব কিছু নিস্তব্ধ তখনই রান্না ঘরে শুরু হয় আরশোলার উৎপাত। সকালে যা টেরও পাওয়া যায় না। তাই অজান্তেই বিষ ছড়ায়।
- আমাদের দেশে খোলা জায়গায় মলত্যাগের কু-অভ্যাস এখনও লক্ষ্য করা যায়। রয়েছে অসংখ্য নিকাশি নালা যেখানে বর্জ্য পদার্থ জমে থাকে। এই সব নোংরা স্থানে মাছি বসার পর তা উড়ে এসে আমাদের খাবারের ওপর বসে। ফলে তাদের গায়ে লেগে থাকা নোংরাগুলো খাবারে বা পাত্রে লেগে যায়। একে Oral-faecal contamination বলে। পানীয় জলে মাধ্যমেও এই দূষণ বিপুল পরিমাণে ঘটে। যার জেরে আমাশা জাতীয় রোগের প্রকোপ এত বেশি।
- ফল যা সচরাচর গাছ থেকে কাঁচা পেড়েই খাওয়া যায় তাতে পাখি ঠোকরালেও এই জাতীয় বিষক্রিয়া ঘটতে পারে। ইদানীংকালে পেয়ারা, লিচু এবং অন্যান্য ফলের মাধ্যমে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনা একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। মূলত বাদুড়ের মাধ্যমেই এই সংক্রমণ ঘটেছিল।
- ইঁদুরের গায়ের লোম খুব দ্রুত বাড়তে থাকে। যার অধিকাংশই টুকরো টুকরো করে ইঁদুর নিজেই খেয়ে ফেলে। এবং তাদের মলের মাধ্যমে তা বেরিয়ে আসে। এই মল শুকিয়ে গেলে সেই লোমের টুকরো খোলা খাবারে উড়ে এসে খাবারে মিশে সংক্রমণ ছাড়ায়।
- ইঁদুর, আরশোলা, মাছি ইত্যাদি পতঙ্গ কোথায় আশ্রয় নেয় জানেন? মূলত ঢাকা ড্রেন, বড় বড় পাইপ বা স্যুয়ার লাইনে বা জলের রিজার্ভার, বেসিনের পাইপ ইত্যাদিতে। যার মাধ্যমে রান্নাঘরের বাসনপত্র, ফল–সবজি, খোলা খাবার ও দানাশস্য দূষিত হয়ে সংক্রমণ ডেকে আনে।
[ জটিলতা থাকলে গর্ভাবস্থায় দরকার সম্পূর্ণ বেড রেস্ট, বলছেন চিকিৎসকরা ]
পোকামাকড় থেকে রোগ ও জীবাণু
- পিঁপড়ের মাধ্যমে ব্যাসিলাস সেরাস ব্যাকটিরিয়া খাবারে মেশে যা থেকে ডায়েরিয়া, বমির সমস্যা দেখা দিতে পারে। মূলত চাল, সস, স্যুপে পিঁপড়ে ধরলে এই ব্যাকটিরিয়া জন্মাতে পারে।
- মাছির মাধ্যমে ছড়ানো ক্যাম্পিলোব্যাকটর যেজুনি ব্যাকটিরিয়া থেকে ফুড পয়জন, ডায়েরিয়া, বমি, মাথাব্যথা, মাসল পেন হতে পারে।
- মূলত বিফ, মুরগির মাংস ইত্যাদি কাঁচা অবস্থায় পিঁপড়ে ও আরশোলা তার সংস্পর্শে এলে ক্লসট্রিডিয়াম পার্ফ্রিজেন্স ব্যাকটিরিয়া ছড়ায়। স্টম্যাক ক্রাম্প, জ্বর, বমির সমস্যা দেখা দেয়।
- মাছি, আরশোলা ও ইঁদুরের মাধ্যমে খাবারে ছড়ানো অ্যান্টোমিবা হিস্টোলিটিকা ব্যাকটিরিয়া শরীরে গেলে তা থেকে তলপেটে ব্যথা, আমাশা বা অ্যামিবায়োসিস, বারবার মলের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- পিঁপড়ে এবং মাছির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এস্কেরিচিয়া কলি ব্যাকটিরিয়া থেকে ডায়েরিয়া সঙ্গে রক্তপাত, বদহজম, ইউরিনারি ট্রাক্ত ইনফেকশন, কিডনি ফেলিওর, নিউমোনিয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- খাবারে বা পাত্রে মাছি ও আরশোলা বসলে তা থেকে ছড়ায় সালমোনেলা স্পিসিস ব্যাকটিরিয়া। যা থেকে অ্যাকিউট গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস, টাইফয়েড ও নিউমোনিয়া প্রকোট হতে পারে।
- পিঁপড়ে ও মাছি বাহিত শিগেলা স্পিসিস থেকেও রক্ত নিউমোনিয়া, তলপেটে ক্রাম্প ও জ্বরের সমস্যা দেখা দেয়।
- পিঁপড়ে, মাছি ও আরশোলা থেকে যদি স্ট্যাপোফাইলোকক্কাস অরিয়াস ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ ছড়ায় সেক্ষেত্রে ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে। র্যাশ বেরোয় ও ত্বক ফুলে যায়।
- পিঁপড়ে ধরা খাবার থেকে অনের সময় স্টেপ্টাকক্কাস প্যাথোজেন ব্যারটিরিয়াও ছড়াতে পারে। যা থেকে রিউমাটিক ফিভার, র্যাশ বেড়িয়ে জ্বর হতে পারে।
[ বসন্তের পরশে ‘অসুস্থ’ ত্বক, তরতাজা থাকুন এভাবে ]
সমাধান
মাংসের ঝোলে কিংবা তরকারিতে অথবা খালি পাত্রে ঘরে ঘুরে বেড়নো কীটপতঙ্গ থেকে ব্যাকটিরিয়া সম্পর্কিত নানা ইনফেকশন শরীরে ছড়ায়। বিশেষ করে যেহেতু এই ধরনের সংক্রমণ মুখের মাধ্যমে যাচ্ছে সেহেতু তা থেকে গ্যাস্ট্রোটেস্টাইন্যাল সমস্যাই বেশি হয়। অর্থাৎ পেটের সমস্যা বা অন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়। যদি এমন হয়, আরশোলা, মাকড়সা ইত্যাদি কোন একটি খাবার খেয়ে গিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে খুব অল্প সময়ের মধ্যে একজন তা না জেনেই সেই খাবার ভক্ষণ করেছেন সেক্ষেত্রে এই খাবার থেকে বিষক্রিয়া খুব কম হয়। তবে দ্বিগুণ ক্ষতির সম্ভাবনা যদি সেই খাবার পোকায় চাটার পর তা দীর্ঘক্ষণ রেখে তারপর ভক্ষণ করা হয়। এতে খাবারে ব্যাকটিরিয়ার খুব বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি পেতে শুরু করে ও শরীরে ক্ষতির সম্ভাবনাও বৃদ্ধি করে। টিকটিকির মল অথবা মাকড়সা কোনও সময় দুধ কিংবা যেকোনও খাবারে পড়লে তা না দেখেই সেই খাবার গরম করে খেলে সেক্ষেত্রে সেই সব কীটপতঙ্গ থেকে যে সব টক্সিন খাবারে মেশে তা শরীরে গেলে তা থেকে ফুড পয়েজন বা টক্সিন সম্পর্কিত গ্যাস্ট্রোএস্টেরাইটিস হতে পারে। এই ধরনের সমস্যায় অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েও সমাধান মেলে না। এক্ষেত্রে টক্সিন শরীর থেকে বেরনোর প্রয়োজনে ডায়ারিয়ার সমস্যা বা বমি হতে শুরু করে। তখন ওআরএস থেরাপি করে রোগীকে সুস্থ রাখা দরকার। তাই যদি কখনও মনে হয় খাবারে পোকামাকড় পড়েছে বা মুখ দিয়ে গিয়েছে তবে সেই খাবার না খাওয়াই উচিত। এছাড়া যেকোনও পাত্রই সবসময় ধুয়ে, মুছে ব্যবহার করা জরুরি।