যা-ই দেখছি তা-ই শেয়ার। ভুল ঠিক কিছু বুঝি, না বুঝি নিমেষেই মেসেজ হয়ে যাচ্ছে ফরওয়ার্ড। পুরনো ছবি এখনকার বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে ফটোশপের মাধ্যমে। ছড়াচ্ছে জনরোষ। স্মার্ট ফোন হাতে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক খুললেই চলছে বিতর্কের ঝড়। আদৌ সেই বিতর্ক কি সুস্থ? সোশ্যাল মিডিয়ার এই ভূমিকা ঘিরে উঠছে প্রশ্ন। শুনলেন সোমনাথ লাহা।
তনুশ্রী চক্রবর্তী
(অভিনেতা)
আমার মনে হয় আমরা যারা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি, তাদের একটা দায়িত্ব রয়েছে। শুধু আমার দিকটাই দেখলাম, নিজেরটা বুঝে বাড়তি কোনও কিছুকে অকারণ প্রাধান্য না দেওয়ার পাশাপাশি সবসময় ভাল কাজকে সাপোর্ট করা উচিত। সোশ্যাল মিডিয়ার ভাল দিকগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করা উচিত। যাতে অন্যরাও বুঝতে পারে সোশ্যাল মিডিয়াটা কেন, কী জন্য। কী এর আসল উদ্দেশ্য। এখন তো কেউ কেউ খুব সহজেই কাউকে ট্রোলিংয়ের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে, সোশ্যাল মিডিয়া একটা এমন কিছু দিলে আমার ফলোয়ার বাড়বে, লাইক আসবে – এটা আমি সাপোর্ট করি না। এমনকী এমন কোনও মন্তব্য বা কমেন্টস যা উসকানি ছড়ায় আমার মনে হয় সেগুলোকে শেয়ার, লাইক, কমেন্টস না দিয়ে ইগনোর করাই উচিত। এক শ্রেণির মানুষ তো সোশ্যাল মিডিয়াকে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছেন। আমি তার বিপক্ষে। আমার মনে হয় সোশ্যাল মিডিয়া যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদের ন্যূনতম শিক্ষাটুকু থাকা উচিত। অশিক্ষিত মানুষজনই উসকানিমূলক মন্তব্য, ভুয়ো পোস্টগুলিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শেয়ার করে থাকেন। একটু যাঁরা শিক্ষিত, ভাবনা, চিন্তা করে কাজ করেন তাঁরা কখনওই এমন কাজ করবেন না, যাতে সমাজে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাই আমাদের সকলের উচিত আরও বেশি করে দায়িত্বশীল হওয়া। তাহলেই আমরা সঠিক অর্থে সোশ্যাল মিডিয়াকে ঠিকভাবে ব্যবহারের যোগ্য মাধ্যম করে তুলতে পারব।
ইমন চক্রবর্তী
(গায়ক)
সোশ্যাল মিডিয়ার ভাল-খারাপ দুটো দিকই রয়েছে। কিন্তু সেটা আমরা এখনও পর্যন্ত সঠিকভাবে বিচার করে উঠতেই পারিনি। সেই জন্যই সঠিকভাবে এখনও পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজেই লাগাতে পারছি না। সোশ্যাল মিডিয়া কেন, সেটাই আমাদের সবার আগে বুঝতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখি সবাই সব কিছু জেনে একেবারে সবজান্তা হয়ে বসে পড়েছেন। যেন সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে তিনি প্লেন, ট্রেন সব কিছুই এক নিমেষে চালিয়ে ফেলবেন। আর এই সব করতে গিয়ে আমরা ক্রমশ বাস্তব জগৎ, নিজেদের অস্তিত্বের শিকড় থেকে দূরে সরে গিয়ে একটা ভার্চুয়াল দুনিয়ার বাসিন্দা হয়ে পড়ছি। নিজের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পুলওয়ামায় আমাদের দেশের সৈনিক যাঁরা নিজেদের প্রাণ হারালেন। তাঁদের পরিবারের কোনও সুরাহা হল কি না তা না ভেবে সোশ্যাল সাইট জুড়ে যেভাবে সুরক্ষা, প্রতিরক্ষা নিয়ে সবকিছু জানেন বোঝেন ভেবে এক—একজন এমন সব মন্তব্য করছেন সেটা দেখলে অবাক হতে হচ্ছে। সোশ্যাল সাইটে আমাদের শিল্পীদের তো প্রতিনিয়ত ট্রোলিং, জাজমেন্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। শিল্পীরা সোশ্যাল সাইটের সৌজন্যে সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় নেটিজেনরা তাঁদের যোগ্য মর্যাদা দিচ্ছেন না, বা বলা ভাল মর্যাদা দেওয়ার জায়গা কমে গিয়েছে। সোশ্যাল সাইটে ঢুকে পড়ে একজন শিল্পীকে সহজেই যেন অপমান করা যায়। অথচ শিল্পী কী করে আজকে এই জায়গায় এল, তার পিছনের সাধনার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। সোশ্যাল সাইটের অ্যাডমিনিস্ট্রেটররা লক্ষ কোটি টাকা এর দৌলতে ঘরে তুলছেন আর মানুষ একজন মানুষকে যোগ্য সম্মানটুকু করতে ভুলে যাচ্ছে। শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে আমরা ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে একটা অদ্ভুত দুনিয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়েছি। আমার মনে হয় আমাদেরও যেমন এই বিষয়ে সচেতন হওয়ার সময় এসেছে, তেমনই প্রশাসনেরও উচিত সোশ্যাল মিডিয়ায় অবাঞ্ছিত বিষয় দেখলে সে ব্যাপারে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া। নইলে ভবিষ্যৎ জীবনযাপন ক্রমশ আরও বেশি দুরূহ হয়ে উঠতে। গল্পের বই পড়া, বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে গিয়ে গল্প করা, আড্ডা দেওয়া এগুলো স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে তাহলে।
ইশা সাহা
(অভিনেতা)
সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে যে পরিস্থিতি এখন সমাজ জীবনে তৈরি হয়েছে আমি সত্যিই বুঝে উঠতে পারছি না যে আমরা আদৌ কোন পথে চলেছি। রাষ্ট্র আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে মানেই আমরা তার অপব্যবহার করতে পারি না। সোশ্যাল মিডিয়া যেন একটা হুজুগে গা ভাসানোর মতো বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউটিউবের মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার প্রশ্ন, আমাদের কি নিজস্ব কাজকর্মের বাইরেও এত সময় সত্যিই রয়েছে? আমরা সবকিছু জানি। সব বিষয়েই আমাদের বক্তব্য রাখতেই হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সামগ্রিকভাবে এই চিত্রই তো দেখি। বেসিক শিক্ষার অভাবে না জেনে ভুল মন্তব্য করে ফেলা। আর তার ফলস্বরূপ আমাদের চারপাশে বহু ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। কলকাতার বুকে কাশ্মীরি ডাক্তার হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। মানুষ ক্রমশ প্রতিহিংসামূলক হয়ে উঠছে। ইতিবাচক চিন্তার পরিবর্তে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা সোশ্যাল মিডিয়ায় হাত ধরে সমাজের বুকে প্রভাবিত হচ্ছে। আমাদের সকলের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই। সবটাই বড্ড বেশি পাবলিক হয়ে গিয়েছে। আর তাই আমাদের মধে্য ইমোশনের অভাব ঘটছে। নবীন, তরুণ প্রজন্ম বা ইয়ুথ বড্ড বেশি সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর হয়ে পড়ছে। তারা বই পড়ে কম। ফেসবুক, হোয়াটঅ্যাপ করে তার থেকে বেশি। টিন এজারের কাছে ফেসবুকটা ভাত-ডালের মতো হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এবার আমাদের নিজেদের কন্ট্রোল করার সময় এসে গিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে নির্ভরশীলতা কমানোটা তাই খুবই প্রয়োজন। তা না হলে লাইক,কমেন্টের জাঁতাকলের মধ্যে পড়ে আমাদের মনের বিকাশ, চিন্তা চেতনাগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.