মোহময়ী ডাপোলি। ঘুরে এসে লিখলেন শুক্তি মুন্সী।
পুণেতে এতদিন বাস করছি, অথচ কাছাকাছি থাকা সমুদ্রের হাতছানি টের পাব না, তা কী করে হয়! ইন্টারনেট ঘেঁটে খোঁজখবরটা জোগাড় করেছিল অংশুই। ডাপোলি তার নাম। ছিমছাম আটপৌরে তার গড়ন-গঠন। ওমা, দীপাশ আর পিউ শোনা ইস্তক ঘ্যানঘ্যান করে চলেছে- আমরাও যাব। দীপাশ তো এককাঠি সরেস। বলে কিনা- ‘শুনেছি, শুনেছি নিস্তব্ধতা মাঝে মাঝে আকাশকে সাক্ষী রেখে বুকের মধ্যে কেমন একটা মোহময় আবেশ গড়ে তোলে।’ অংশুর মাথা ধরে গিয়েছে। রুহিকে নিয়ে শুতে চলে গেল। মুখে বিরক্তি, মনে বেড়াতে যাওয়ার গোপন আনন্দ। এদিকে আমাদের তিন বন্ধুর টেলি-কনফারেন্স জারি।
পিউ বলল, ‘ডাপোলি কী জন্য বিখ্যাত বল তো?’
–কী জন্য?
–আরে বাবা, মহারাষ্ট্রে আছিস ধান্ধ কেশব কার্ভের নাম শুনিসনি! পশ্চিম ভারতের বিখ্যাত সমাজ-সংস্কারক। বিশেষত নারী কল্যাণে তাঁর অবদান অপরিসীম। ভারতরত্নও পেয়েছেন। এই কেশব কার্ভের জন্মস্থান এই ডাপোলি।
দীপাশ অধৈর্য হয়ে বলে উঠল- ‘অ্যাই শোন, আমরা পুনে থেকেই যাব। আমরা সবাই মিলে তোর কাছে যাচ্ছি।’
সব কথা বন্ধ। মাত্র দিন দুয়েকের প্রস্তুতি।
মহারাষ্ট্রের গ্রামের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে। খুব ছিমছাম গ্রামীণ গৃহস্থালি। গ্রামবাসীরা খুব পরিচ্ছন্ন। অভাব-দারিদ্র থমকে আছে তাদের ঘরোয়া রুচির কাছে। সহ্যাদ্রি পাহাড়ের একটা অংশ এই অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে, ফলে পথে বেশ কিছু টিলার পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। যাওয়ার পথে পড়ল সারং, কেলাসি, পাঙ্গরি, দাভিল প্রভৃতি গ্রাম। অসাধারণ বেশ কিছু নারকেল বাগানও দেখলাম। তবে সময়ের জন্য দূর থেকেই দ্যাখা, কাছে ঘুরেফিরে দেখার সুযোগ হল না।
অবশেষে ঢুকে পড়লাম ডাপোলিতে। জায়গাটা আরব সাগরের তটবর্তী। ডাপোলি ছাড়াও বুরন্ডি, কেলাসি প্রায় হাত ধরাধরি করে থাকা সমুদ্রতট। এর ঠিক বিপরীতে আছে কোঙ্কণ উপকূল। ডাপোলিকে বলা হয় মহাবালেশ্বরের ক্ষুদ্র সংস্করণ। সারা বছরই আবহাওয়া মনোরম।
ডাপোলির সেরা সৈকত কার্দে। এরই কাছাকাছি একটা রিসর্টে থাকার ব্যবস্থা অংশু আগে থেকেই করে রেখেছিল। জায়গাটা এমনই হাতের কাছে, সবই মেলে। পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। মালপত্র রিসর্টে রাখার অপেক্ষা শুধু। বাচ্চাগুলো দে ছুট সাগরতীরে। রাতের সমুদ্র দ্যাখার অন্য এক আনন্দ আছে। জীবনের সঙ্গে অদ্ভুত মিল দেখে চমকে উঠেছি। সবাই মিলে পাশাপাশি বসে রয়েছি। চাঁদের মায়াবী আলো পড়েছে সমুদ্রে। তবে সেই আলোর ছটা সমুদ্রের সবখানে সমান নয়। কোথাও আলো, কোথাও অন্ধকার। দূরে দূরে সেই আলোর বিন্দু।
রুহি মুগ্ধ হয়ে দেখছে রাতের সমুদ্র। সোঁ সোঁ হাওয়া। ভিজে গন্ধ। নিস্তব্ধতা ভেঙে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দের মাঝে লুকিয়ে থাকা নিঃসঙ্গতাকে রুহি খুঁজে পেয়েছে। গভীর শ্বাস ছেড়ে ইশারায় দ্যাখায় দূরের আলো জ্বলা নিরুদ্দেশে যাত্রা করা ট্রলারগুলোকে।
দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা বদলে যায়। সকালে সূর্যোদয় দেখলাম প্রাণভরে। এই বিহ্বলতা তুলনাহীন। যারা প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করতে পারে, তাদের সকলের এমন আত্মহারা অবস্থা হয়। একটা দৃশ্য বড় অদ্ভুত- এখানকার তট বালুকাবেলা নয়। শক্ত কালচে মাটির মসৃণ ডাঙা। তাই গাড়িও অনায়াসে চালানো যায়।
এই নিরালা বিচ বেলা বাড়তেই সরগরম হয়ে ওঠে। উইকএন্ডে ছুটি কাটাতে আসা মানুষজন সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এখানে ঢেউ কম, তবে স্রোত বেশি। সবাই মিলে খানিক জল-হুল্লোড় করে উঠে পড়ি। তিনদিনের এই আলগা সফরে একটা দিন বরাদ্দ ছিল স্থানীয় দ্রষ্টব্য দেখায়।
ডাপোলি একসময় ব্রিটিশ ফৌজের আড্ডা ছিল। এখানে আছে পশ্চিম ভারতের বিখ্যাত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ড. বালাসাহেব সাওয়ান্ত কোঙ্কণ কৃষি বিদ্যাপীঠ। এখানকার হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজটিও ভারত-বিখ্যাত। এগুলোর সঙ্গে দেখে নিলাম গণপতি মন্দির, পরশুরাম ভূমি বরুন্দি আর সুবর্ণদর্গ কেল্লা। ইতিহাস আর পৌরাণিক আখ্যান যেখানে যুগ যুগ ধরে বেঁচে আছে।
এই তিনটে দিন প্রকৃতির কোল জুড়ে ছিলাম। ফিরতে হবে আবার সেই ব্যস্ত জীবনে। সমুদ্রের কাছে শুধু এইটুকু নিবেদন- স্মৃতি হয়ে ধরে রেখো। চিরদিন।
কীভাবে যাবেন
কলকাতা স্টেশন থেকে ছাড়ছে কলকাতা-পুণে দুরন্ত এক্সপ্রেস। সাঁতরাগাছি থেকে ছাড়ছে হামসফর এক্সপ্রেস। হাওড়া থেকে পুণে যাওয়ার জন্য আছে আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেস। ছাড়ছে রাত ৯ টায়।
পুণে থেকেই ডাপোলি যাওয়া সুবিধেজনক। কাছাকাছি মেদ রেল স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে ২৯ কিমি দূরে ডাপোলি। মুম্বই থেকে ট্রেনে কিংবা সড়কপথে যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন
সরকারি ও বেসরকারি দু’রকমই হোটেল ও রিসর্ট আছে বিভিন্ন দামের ও মানের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.