তিতাস: ট্র্যানকুয়েবর৷ তামিল ভাষায় যার অর্থ ‘যেখানে সমুদ্রের ঢেউ একসঙ্গে গুনগুনিয়ে ওঠে৷’ বর্তমানে এ জায়গার নাম হয়েছে থরঙ্গমবাড়ি অথবা সহজ বাংলায় তরঙ্গমবাড়ি৷ চেন্নাই থেকে ২৮৩ কিলোমিটার দূরে তামিলনাড়ুর তটের ওপর ছোট্ট জনপদ৷ নিরিবিলি সমুদ্রতট৷ বঙ্গোপসাগরের ঢেউ এখানে ভিজিয়ে দেবে যখন-তখন৷ খানিক দূরে বালির চরেও সময় কাটানোর জন্য আদর্শ এই তট৷ চেন্নাই থেকে সপ্তাহান্তে বেশ ভাল পর্যটকের আনাগোনা এই জনপদে৷
সমুদ্রতট থেকে ২০০ মিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে সুবিশাল ড্যানসবর্গ কেল্লা৷ আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগের কথা৷ একদল নাবিক ড্যানিশ অ্যাডমিরাল ওভে জেদে-র নেতৃত্বে ভারতবর্ষের সঙ্গে ডেনমার্কের বৈষয়িক সম্পর্ক স্থাপনের কথা ভেবে এসে পৌঁছান তরঙ্গমবাড়িতে৷ তখন এ জায়গা থাঞ্জাভুরের রাজা বিজয় রঘুনাথ নায়কের শাসনে৷ বাণিজ্যের সমস্ত পরিস্থিতি উজ্জ্বল দেখে ১৬২০ সালের ২০ নভেম্বর ডেনমার্কের তৎকালীন রাজা ক্রিশ্চিয়ান চতুর্থর প্রতিনিধি হিসেবে জেদে চুক্তি করতে আসেন রাজার সঙ্গে৷ চুক্তির কথামতো সমুদ্রতটে কেল্লা গড়ে তোলার অনুমতি দেন রাজা৷ সেই বছরই শুরু হয় কেল্লা নির্মাণের কাজ৷ তারই সঙ্গে শুরু হয় মরিচ ও অন্যান্য মশলার রপ্তানি৷
দু’তলাবিশিষ্ট এই কেল্লার নিচতলা ব্যবহৃত হত সৈন্যদের বাসস্থান ও ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে৷ একই তলার অন্য দিকে রাখা হত রপ্তানির সরঞ্জাম৷ কেল্লার উপর তলায় ছিল গভর্নর ও পুরোহিতদের থাকার জায়গা৷ প্রায় ১৫০ বছর এই দুর্গের পথ ধরেই ভারত থেকে সুদূর ডেনমার্কে পৌঁছে যেত মশলাপাতি৷ ক্রমে ড্যানিশ নাবিকেরা শ্রীলঙ্কার পথে এগিয়ে যান৷ এরপর ১৮৪৫ সালে ব্রিটিশের কাছে হস্তান্তর হয় এই কেল্লা৷ সাড়ে বারো লাখ টাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিনে নেয় এই কেল্লা৷ জমজমাট বাণিজ্যের পথে মরচে ধরে, শেষে এই পথে বন্ধ হয় রপ্তানি৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর ইন্সপেকশন বাংলো হিসেবে কেল্লার ব্যবহার শুরু করেন রাজ্য সরকার৷ ১৯৭৮ সালে ‘ডিপার্টমেন্ট অফ আর্কিওলজি’-র অধীনে এসে সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত হয় ড্যানসবর্গ কেল্লা৷
ড্যানিশ স্থাপত্যের এক চোখ-জুড়ানো নিদর্শন এই কেল্লা ২০০ ফুট উঁচু৷ পায়ে হেঁটেই ঘুরে দেখতে হবে কেল্লা৷ ড্যানিশদের হাতে তৈরি হয় দরজা, যাকে বলা হয় টাউন গেট, ড্যানিশ ভাষায় এর নাম ল্যান্ডপোর্টেন৷ প্রাচীরের এই অংশ ভেঙে ফেলে ১৭৯১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর পিটার অ্যানকার একই জায়গায় নতুন গেট নির্মাণ করেন৷ ট্র্যাপেজেইডাল অর্থাত্ অসমান্তরাল বাহুবিশিষ্ট চতুর্ভুজের আকারে তৈরি হয় এই কেল্লা৷ ২০০৪ সালের সুনামিতে কেল্লা খানিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভেঙে পড়ে কেল্লার প্রাচীর ও দু’একটা অংশ৷
তার পরেও কেল্লার ভিতর সংগ্রহশালা দেখার মতন৷ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে কেল্লা হস্তান্তরের দলিল, পাণ্ডুলিপি, কাচ ও পোর্সিলিনের দুর্দান্ত সমস্ত জিনিস, তখনকার ব্যবহৃত আলো, চিনে টি-জার, ব্যবহৃত বাসনপত্র, পাথরের জিনিস, পুতুল, টেরাকোটার মূর্তি- কী নেই! রয়েছে চোল যুগের ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী৷ ১০ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর সময়কালে এখানে শাসন করে চোল ও পাণ্ড্য বংশ৷ তাই সেই সময়ের কিছু সামগ্রীও রাখা রয়েছে সযত্নে৷
ড্যানসবর্গ কেল্লার বাইরে নগর প্রাচীর প্রাঙ্গণে রয়েছে ১৭০১ সালে তৈরি জিয়ন গির্জা, যা ভারতবর্ষের প্রথম প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জা৷ ১৭১৮ সালে তৈরি নিউ জেরুজালেম গির্জাও চোখে পড়বে এখানে৷ নগর প্রাচীরের আদল দেখে মনে হবে এ যেন ছোট্ট কোনও ইউরোপীয় জনপদ৷ রয়েছে কাঠের প্রবেশদ্বার ঘেরা কিংস স্ট্রিট৷ সেখানেই সারিবদ্ধ গেট হাউজ, মুলডর্ফস হাউজ, পোর্ট মাস্টার বাংলো, রেহলিং’স হাউজ৷ ডেনমার্ক থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্যই পরবর্তীকালে কেল্লার প্রাঙ্গণে এই ছোট্ট নগর গড়ে ওঠে বলে জানা যায়৷
ড্যানসবর্গ কেল্লার কিছু দূরে পায়ে হাঁটা পথে ঘুরে আসুন ড্যানিশ সেমেট্রি৷ তৎকালীন ড্যানিশ আধিকারিক, অফিসার ও ব্যবসায়ী সমাধিস্থ রয়েছেন এখানে৷ সমুদ্রতটের ওপরই ঘুরে দেখুন ১৩ শতাব্দীতে তৈরি মাসিলামানিপাথর মন্দির৷ পাণ্ড্য রাজা মারাবর্মন কুলশেখর তৈরি করেন এই মন্দির৷
সবশেষে বালির চরে নীল সমুদ্র থেকে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের আনাগোনা উপভোগ করুন৷ জলের তোড় পায়ে এসে লাগবে৷ চোখে পড়বে ইতিহাসমাখা ড্যানসবর্গ কেল্লার ভেঙে আসা পাঁচিলের টুকরো৷ সূর্যাস্তের পর তরঙ্গমবাড়ির রূপ দেখার মতো৷ মাথার ওপর তখন ঝলমলে আকাশ আর কান পাতলেই সঙ্গ দেবে ঢেউয়ের সমবেত কলতান৷
কীভাবে যাবেন:
তরঙ্গমবাড়ি থেকে চেন্নাইয়ের দূরত্ব ২২২ কিলোমিটার৷ চেন্নাই থেকে প্রচুর বাস পাবেন৷ সময় লাগবে ৭-৮ ঘণ্টা৷ পুদুচেরি, চিদম্বরম ও বেঙ্গালুরু থেকেও তরঙ্গমবাড়ি পৌঁছানো যায়৷
কোথায় থাকবেন:
দ্য বাংলো অন দ্য বিচ৷ অগ্রিম বুকিং প্রয়োজন৷
কখন যাবেন:
সারা বছর, তবে বর্ষাকালে না যাওয়াই ভাল৷
সঙ্গে রাখুন:
জল ও শুকনো খাবার সঙ্গে রাখুন, প্রয়োজনে জরুরি ওষুধ৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.