পুণ্যের টান, অথবা শুধুই ভ্রমণ। কিছু কিংবদন্তি, কিছু বেড়ানোর নেশা। খানিক ধর্মকর্ম, খানিক প্রকৃতির কোলে বিভোর হয়ে থাকা। সব মিলিয়েই সাগর সঙ্গম। আক্ষরিক অর্থেই তা সঙ্গম। যা আজও মনে করিয়ে দেয় ভারতের সনাতন সংস্কৃতি, বৈচিত্রের মধ্যে মহামিলনের কথা। লিখছেন ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় ।
শীত পড়লেই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। খেজুরের গুড়, পাটালি, জয়নগরের মোয়া, কড়াইশুঁটি, নবান্ন, পিঠেপুলি আর লেপ বালাপোশ মনে করিয়ে দেয় আরও দুটি অনুষঙ্গ, পৌষপার্বণ আর মকরসংক্রান্তি যার নাম। সূর্য তার নির্ঘণ্ট মেনে ধনুরাশি থেকে মকরে প্রবেশ করবে। উষ্ণতার পারদ নামবে চড়চড় করে। জাঁকিয়ে শীত পড়বে তবেই তো হবে মকরস্নান। আর সেই স্নান হবে মোহানায় অর্থাৎ গঙ্গা যেখানে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি সেই মোহানার কথা। বছরে একটিবার সেই পয়েন্টটি হয় খবরের কাগজের শিরোনাম। মিডিয়ার ক্যামেরায় ধরা পড়ে তার কুয়াশামাখা ছবি, দূর দূর থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের আসা যাওয়ার গল্প, সরকারি রক্ষণাবেক্ষণ, পুছতাছ কেন্দ্র আরও কতকিছু খবর। লাইমলাইটে আসে বছরে একটিবার এই সাগরদ্বীপ। মেলাময় হয়ে ওঠে সমুদ্রপাড়। বালুকাবেলায় পায়ের ছাপ পড়ে অগণিত মানুষের। আশ্রম সংস্কৃতির সনাতন ফল্গুধারা, তীর্থময়তার সাথে কীর্তনের অণুরণন, আর কপিলমুনি-সগররাজা-ভগীরথের গঙ্গাপ্রীতি সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় সাগরপাড়ে। সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় সাগরপাড়ে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে আবক্ষ জলে নিমজ্জিত লাখ লাখ মানুষ সোচ্চারিত হয় মন্ত্রোচ্চারণে…
[ পথের বাঁকে ইতিহাস, ডালিমগড় চেনেন কি? ]
লাখো লাখো মানুষের জনস্রোতে কোলাহল মুখর হয় সাগরতীর। তাদের ভিন্ন রুচি, আচার ব্যবহার। কিন্তু সাগর তীর্থে এসে সব মিলেমিশে এক হয়ে যায় কটা দিনের মত। প্রতিটি মানুষের ভিন্ন সংস্কার। কেউ আধ্যাত্মিক, কেউ নিতান্তই ভ্রমণপিপাসু। সাধুসন্তরা পুজোপাঠের সাথেসাথে গঞ্জিকাসেবন করছেন হয়তো। কোনও নাগা সন্ন্যাসী ছাইভস্ম মেখে বসে থাকেন শীতের সময়। থাকুকনা তাঁরা তাঁদের মতো। আমি বলি আমাকে আমার মত থাকতে দাও। কলকাতার কাছেই সে সঙ্গম। গঙ্গা যেখানে আত্মসমর্পণ করেছে বঙ্গোপসাগরে। তাই অঘ্রাণেই নিরালায় পাড়ি দিলাম এক ভোরে। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলা আর রবিঠাকুরের দেবতার গ্রাস স্মৃতি তাড়িয়ে নিয়ে চলল আমায়। মৈত্রমশায়ের মত আমাদেরও সাগরসঙ্গমে যাবার জন্য সঙ্গী জুটে গেল এক পড়শি দম্পতি।
[ গড়পঞ্চকোট কথা: যেখানে নাগালে প্রকৃতি, পিছনে ইতিহাস ]
মকরসংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে যখন লাখে লাখে মানুষ সমুদ্রে জমায়েত হয়, তখন বুঝি এই নিরবচ্ছিন্ন শূন্যতা পায়না তাঁরা। কিছুটা হুজুগে, কিছুটা পুণ্যিলাভের আশায় ঠিক ঐ সময়েই যাওয়াটাই যাদের কাছে বড় কথা তারা বুঝি সে রসে বঞ্চিত । কিন্তু আমার চাই শূন্যতা। শহরের ভিড় ছেড়ে দু-দণ্ড জিরেন। সূর্য যখন আপনমনে রং ছড়াতে ছড়াতে বলে ওঠে, পুবের ভোর ভরেছ দুচোখে? সাগর বলে ওঠে, ওই দ্যাখো ঢেউ। একটা দুটো শামুক-ঝিনুক পেলেও পেতে পার। আর মন্দির বলে আমি আবহমানকালের মহাস্থবির জাতক। বসে আছি তোমার দেশের কিংবদন্তির দলিল সাজিয়ে।
সে কাহিনি রামায়ণ-মহাভারতের যুগেরও আগের। মানে ত্রেতা-দ্বাপরযুগেরও প্রাচীন। সে গল্পের শিকড় প্রোথিত সত্যযুগে। ভারতবর্ষ তখন সবেমাত্র ধর্ম জিনিসটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করেছে। সাংখ্যদর্শনের কচকচি নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন কপিল নামে একজন ঋষি। তাঁর নাকি আশ্রম আছে গঙ্গা সাগরে। যে আশ্রমের কথা আছে পুরাণে। স্বর্গ থেকে গঙ্গাধারাকে মর্ত্যে নামিয়ে এনে সগর রাজার ষাট হাজার পুত্রদের আত্মার মুক্তি সম্ভব হয়েছিল এখানে। তাই এ স্থান হল মহাতীর্থ। গঙ্গা হয়েছিল দক্ষিণমুখী। সোজা হাজির কপিলমুনির আশ্রমের দিকে। আর বঙ্গের মধ্যে গঙ্গার এই দক্ষিণমুখী শেষ ধারাটির নাম হল ভাগীরথী। সাগরদ্বীপে গঙ্গার জলের স্পর্শে সগরমুণির ষাটহাজার পুত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হলে মুক্ত হল আত্মা। শান্তি পেল তাদের পারলৌকিক আত্মা। উদ্ধার হয়ে স্বর্গে পাড়ি দিল তারা। লীলায়িত ছন্দে গঙ্গা যেন ঝাঁপ দিলেন সমুদ্রে। গঙ্গার সাথে সাগরের মিলন হল আর এই স্থান বিখ্যাত হল সাগরসঙ্গম বা গঙ্গাসাগর নামে।
[ এ রাজ্যে আছে আরও এক গঙ্গাসাগর, পুণ্যস্নানে তৈরি তো? ]
আর সেখানে অগণিত ভক্তের মাঝে নারায়ণের স্তবস্তুতি আর কপিলমুনির মন্দিরে রাম-সীতার বিগ্রহের কারণ একটাই। রামচন্দ্র হলেন এই সগররাজের প্রত্যক্ষ বংশধর। আর তাই বুঝি প্রতিবছর মকরসংক্রান্তির দিনে উত্তর ভারত তথা অযোধ্যার অগণিত পুণ্যার্থীর সমাবেশ হয় হয় সাগরের মেলায়। কপিলমুনির প্রধান মন্দিরে কপিলমুনি, রাজা সগর-সহ মা গঙ্গার কোলে ভগীরথ, অশ্বমেধের ঘোড়া, রামসীতা, হনুমান এবং কালী-মহাদেবের সাথে মা সিংহবাহিনীও পূজিতা হন।
কলকাতা থেকে গাড়ি করে যাওয়াটাও এখন সহজ হয়েছে। ডায়মন্ড হারবার রোড দিয়ে কাকদ্বীপ অবধি গিয়ে হারউড পয়েন্ট থেকে ফেরি নিতে হবে। সকল তীর্থযাত্রীরা সেই পয়েন্টে জমায়েত হন। এইস্থানকে লট-৮ এর ঘাটও বলে। জেটি পেরিয়ে স্টিমারে করে সাগরদ্বীপ পৌঁছতে সময় লাগে ৪৫ মিনিটের মত। গাড়ি ওপারে গ্রাম পঞ্চায়েতের সুবন্দোবস্তে পার্কিং ফি দিয়ে রেখে চলে যাওয়া যায়। কচুবেড়িয়া পৌঁছে এবার ভাড়ার গাড়ি করে গঙ্গাসাগর যেতে লাগে ঘণ্টাখানেক। স্টিমারে করে যেতে যেতে অজস্র সিগালের ঝাঁক যাত্রীদের ছড়িয়ে দেওয়া দানার লোভে কাছে আসে। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়। সেখানে হাজির হয়েই সোজা সমুদ্রের ধারে পোঁছলাম। সূর্যাস্ত দেখলাম প্রথম দিন। পরদিন ভোরে উঠেই সূর্যোদয় আর পুজো দেওয়া মা গঙ্গাকে। অঘ্রাণে গিয়েছিলাম আমরা, হালকা শীতে তাই কাঁপুনি কম। উলটে নিরিবিলি স্নান এবং নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপে ঘাটেই শান্তিতে পোশাক বদলের ব্যাবস্থা। কাজেই ভিড়-ভাট্টা তো নেইই বরং বেশি করে পাওয়া হল সমুদ্রকে। আমাদের মা গঙ্গাকে। তখন স্নানে পুণ্যি কম হলেও মনের শান্তি আর উপভোগ্যতা বেশি।
এ এক মহাতীর্থক্ষেত্র যেখানে এখনও হোটেল গড়ে ওঠেনি, শহরায়নের হিড়িক নেই তেমন। তবে আশ্রম সংলগ্ন ছোট হোটেলে দিব্য পাওয়া যায় সস্তার সুস্বাদু আমিষ এবং নিরামিষ আহার। এ এক অভিনব মিলনক্ষেত্র যেখানে গেলেই ঊষা আর সন্ধ্যের ব্রাহ্ম মুহূর্তে শোনা যায় সম্মিলিত শাঁখের আওয়াজ, খোল করতাল, খঞ্জিরা, মঞ্জিরায় কীর্তনের অণুরণন। অগণিত মহাপুরুষরা নিজ নিজ আশ্রম গড়েছিলেন সাগরপাড়ে। মন্দির তুলেছিলেন আরাধ্যা দেবদেবীর। এখনো তাঁদের উত্তরসূরিরা সেখানে ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছে। স্থান দিচ্ছে তীর্থযাত্রীদের। প্রসাদ বিতরণ করছে। সন্ধ্যেয় তুলসীতলায় প্রদীপ থেকে ভোর চারটেয় মঙ্গলারতি কিছুই বাদ পড়ছে না সেখানে। এক স্বর্গীয় আবহ যেন। ঘুম ভাঙতেই শুনি এক মন্দিরের শঙ্খধ্বনি দিয়ে শুরু মঙ্গলারতি, তা শেষ হতে হতেই আরেক মন্দির থেকে ভেসে আসে ঘন্টাধ্বনি। হিমেল বাতাসে, হালকা স্বরে ভজন শুরু হয় তারপর। সেই ভজনের সুর কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশিল যেন। শহরে ফেরার কথা ভাবলেই গায়ে জ্বর।
[ প্রকৃতির স্বাদ এবং পরিযায়ী পাখি চাক্ষুস করতে ঘুরে আসুন সিঙ্গি গ্রামে ]
কত রকমের মানুষ, কত জাতের মানুষ, কত ভাষার মানুষ তাদের ভিন্ন সাংস্কৃতিক বাতাবরণ থেকে হাজির হয় এই সাগরস্নানে। আবারও মনে করিয়ে দেয় সনাতন ভারতের সেই সংস্কৃতির ফল্গুধারা যা গিয়ে মিশেছে সাগরের জলে। এই সাগর যেন আদতে সনাতন হিন্দুধর্মের এক মেল্টিংপট। আবারও মনে করিয়ে দেয় কবির সেই অমোঘ কথাগুলি “নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে হের মিলন মহান”। আবার ভাবি আরেকটি কথা। কে জানত এই সাগরের কাহিনি? কে জানত এই মিলন তীর্থের কথা? যদি শিকেয় তুলে রাখি কিংবদন্তির কড়চা তাহলেও বলি আমাদের দেশের অনেক ভ্রমণপিপাসু মানুষ কিন্তু জানেন না এই তীর্থের কথা। কিন্তু যখন অগণিত মানুষের স্রোত সুদূর উত্তর ভারত থেকে এইখানে আসেন মকরস্নানের পুণ্যিলাভের আশায় তখন মনে হয় এই গঙ্গাসাগরের স্থানমাহাত্ম্য কি এতই প্রবল যে, এত একটি বিপদসঙ্কুল স্থানে তারা এসে পৌঁছেও যায় প্রতিবছরে। তাই সবশেষে বলি বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। অথবা সেই স্থানে ভ্রমণ কালে তার স্থানমাহাত্ম্য অনুভব করে বলি “যাহা রটে তাহা কিছু বটে”।
ছবি: শুভাশিস রায় ও লেখিকা
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.