সাত বোনের উত্তরপূর্ব। আজ মণিপুরের গল্প। রঙিন রাজ্য ঘুরে এসে লিখছেন সোহিনী সেন৷
আমাদের ছাদে একটা পুরনো খাঁচা আছে। অবাঞ্ছিত। অপাংক্তেয়। অপ্রয়োজনীয়। অনেকদিন ধরেই পড়ে। সম্প্রতি তার শরীর বেয়ে উঠেছে পাশের টবের লতানে গাছখানা। বসতি জমিয়েছে পাঁচিল বেয়ে। হরাইজন্টাল। ধূসর পাঁচিলের গায়ের সবুজ ঘন থাক। তার উপর দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ। নীল-সবুজের এই সমান্তরাল সঙ্গম ছাদ-চৌকাঠে দেখতে দেখতে বারবার মনে হয়েছে, চোখজুড়ে এই দুই রঙের কথকতা রয়ে যাবে এমন কোনও জায়গা আছে?
মণিপুরের পাতায় পাতায় দেখে এলাম এই দুই রঙের মূর্ত ক্যানভাস। কেবল বদলে বদলে গিয়েছে শেডগুলো। যা একবার চোখ দিয়ে ছুঁয়ে ফেললে দৃশ্যান্তের ভয় লেপটে যায় চোখে। যার গভীর মানচিত্রে লুকিয়ে থাকে প্রশান্তির আল।ছোট্ট একটুকরো রাজ্য। রাজনৈতিক প্যাঁচ পয়জার, আন্তরাজ্য বিবাদ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত। ‘মণিপুর’ উচ্চারিত হলেই মনে পড়ে – নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির উত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গনগনে ধোঁয়া; আবার ‘মণিপুর’ উচ্চারিত হলে মনে পড়ে ‘মেংগোউবি’, ‘আয়রন লেডি’ ইরম শর্মিলা চানুকে৷ মনে পড়ে মেরি কমের মুখ। সেভেন সিস্টারস স্টেটের অন্যতম এই রাজ্যে এক্স এক্স ক্রোমোজমের দাপট বেশি। সারা ভারত, মায় সারা পৃথিবী যখন পিতৃতান্ত্রিক আস্ফালনে দাসখত দিতে ব্যস্ত, তখন ভারতের এই রাজ্যটি সদর্পে ওড়ায় মাতৃতন্ত্রের নিশান। পৃথিবীর কাছে
হয়ে ওঠে অনন্য উদাহরণ।
তবে এসব ছাপিয়ে মণিপুরকে যা স্বতন্ত্র করে, তা হল এখানকার ভূমি ইতিহাস ও বাকরুদ্ধ করা প্রকৃতি। রাজধানী ইম্ফল ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর বিষ্ণুপুরের প্রকৃতি বর্ণনা রইল এখানে (যেহেতু অন্য জায়গায় যাওয়া হয়নি সময়ের অভাবে)৷ সেরকমই চার জায়গার হদিশ যা দেখে ভাষা হারিয়েছিলাম। ভাষা অবিশ্যি হারিয়েছিলাম স্থানীয় ভাষা মেইতেই-এর হরফ দেখেও – হুবহু বাংলা!
প্রথম গন্তব্য ছিল ইম্ফল থেকে ৩৯ কিলোমিটার দূরে বিষ্ণুপুরের লোকটাকে।
লোকটাক হ্রদ
ফিরোজা রঙের জল। মধ্যে মধ্যে ঘন সবুজ গাছ। দূরে আলাদা আলাদা সবুজের পরত মাখা নিঃসীম পাহাড়। মাথার উপর শামিয়ানার মতো টাঙানো আজুর আকাশ। লেন্সে চোখ রাখলে মনে হবে, কোনও অদৃশ্য ডাকহরকরার হাতে যেন একটা নীল-সবুজ পোস্টকার্ড এসে পৌঁছেছে। তাতে বুঝিবা লেখা আছে হৃদয় আর অলিন্দের পারস্পরিক কথোপকথন। তাদের গুপ্তভাষায়। যা বুঝে উঠতে পারছে না হরকরা। নিমগ্ন হয়ে আবিষ্কারের চেষ্টায় বুঁদ হয়ে গিয়েছে। বিশ্বের একমাত্র ভাসমান হ্রদ লোকটাকের সঙ্গে প্রথম এনকাউন্টার এভাবেই। স্পিডবোটের টিকিট কেটে যখন ঘাটের পাশে একদৃষ্টে দাঁড়িয়ে আছি, তখন মনে হচ্ছিল, এই জায়গাটা থেকে ফিরেও যেতে হবে কোনও এক সময়? লোকটাকের সিনিক এমনই।
হ্রদটি মণিপুরের লাইফলাইন। বিষ্ণপুরের এই হ্রদ ৪০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় মিষ্টি জলের হ্রদ। ‘ফ্রেশ ওয়াটার লেক’ বলা হয়। কিন্তু ভাসমান কেন? জৈব পদার্থ, গাছপালা, মাটির উপর তৈরি হয় ‘ফামদি’ (ঘাস)। স্থানীয় ভাষায় ‘ফামশাং’। এই ফামশাং ১৫ ফুটের উপর লম্বা। ফামশাং দিয়েই তৈরি হয় ভাসমান দ্বীপ। যা অল্পবিস্তর নড়েচড়ে বেড়ায়। অর্থাৎ, যার স্থান পরিবর্তন হয়। এই ঘটনার জন্যই লোকটাক ‘ফ্লোটিং লেক’-এর শিরোপা পেয়েছে। ১৯৯০ সালের মার্চে রামসের কনভেনশনের আওতায় আসে বিশ্বের এই ভাসমান বিস্ময়। নিকটবর্তী সেন্দ্রা হিল থেকে আরও মগ্ন হয়ে এই নিসর্গ সন্দর্শন করা যায়। লোকটাক মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল।
কেইবুল লামজাও
সেই মুগ্ধতা নিয়েই পাড়ি জমাই কেইবুল লামজাওতে। বিশ্বের একমাত্র ভাসমান জাতীয় উদ্যানে। লোকটাকের দক্ষিণ-পূর্বে কেইবুল লামজাও। ফামশাং দিয়ে তৈরি ছোটখাটো দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। ফামদি বা ফামশাং সমগ্র উদ্যানের চারভাগের তিনভাগ জুড়ে। ০.৮ মিটার থেকে দু’মিটার পর্যন্ত পুরু। ১৯৫৪ পর্যন্ত ৫২০০ মিটার জায়গাজুড়ে উদ্যানটি বিস্তৃত থাকলেও ১৯৭৭-এর ২৮ মার্চ ৪০০০ হেক্টরকে জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃত দেওয়া হয়। এইসব ইতিহাস শোনাচ্ছেন নৌকার চালক। দু’পাশে ঘন গগনচুম্বী ফামশাংকে সাক্ষী করে এক ফালি জল দিয়ে বোট এগচ্ছে।
আশা, এল্ডস ডিয়ারের দেখা পাব– যার জন্য সুদূর কলকাতা থেকে অ্যাদ্দুর আসা। এল্ডস ডিয়ার বা সানহাই ডিয়ার বা নাচুনি হরিণ।
এও মণিপুরের তথা ভারতের তথা বিশ্বের বিস্ময়। ভাসমান উদ্যানে পা ফেললেই উদ্যান নড়ে নড়ে ওঠে। তাই হরিণ বাবাজীবন আলতো
আলতো পা ফেলে এদিক-সেদিক বাঁকেন। দেখে মনে হয় যেন নাচছেন! অধুনা বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের একটি। নৌকাচালক জানান, ভোর সাড়ে ছ’টা-সাতটা নাগাদ এলে কালেভদ্রে তেনাদের দেখা মেলে। নিজেদের ব্যাড লাকটাই খারাপ ধরে নিয়ে ঘন ফামশাংয়ের ঝোপে নামলাম। লম্ফঝম্প করলাম। খানিক পরে আবার উঠেও গেলাম, পুরো বক্সিং রিংয়ের মতো! বা পাঞ্চিং ডলের পেটের মতো! ৫৪ প্রজাতির মাছ, ২৫ প্রজাতির উভচর, মালায়ান বিয়ার, মারবেলড ক্যাট বা ওয়াইল্ড বোরেদের কারওর দেখা মিলল না বটে, তবে লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স সঙ্গে নিয়ে ফিরলাম। পিছনে তখন তিনদিক ঘেরা সবুজ পাহাড়। মনখারাপের কুয়াশা। ব্যাকুলের লোকটাক।
কাংলা ফোর্ট
মূল ইম্ফল শহরেই এই ফোর্ট। একদা এটিই ছিল মণিপুর রাজপ্রাসাদ। পিছন দিয়ে বয়ে যায় স্বচ্ছতোয়া ইম্ফল নদী। দূর থেকে দেখি, আধা
সিংহ আধা ড্রাগন গোছের একটা প্রাণী। সাদা রংয়ের। বিশালাকার। তার শরীরে বিকেলের চাপা রোদ। আমাদের গাইড মালেম। ইন—কার (ব্যাটারিচালিত ছোট এই গাড়িতে করেই সারা ফোর্ট ঘোরায় মহিলা গাইডরা) চালাতে চালাতে সে জানায়, প্রাণীটির নাম ‘কাংলা শা’; মণিপুরের স্টেট এমব্লেম। মেইতেই জনগোষ্ঠীরও। এবং আমার অনুমানকেই সঠিক বলে সিলমোহর দেয় মালেম, বলে প্রাণীটি সত্যিই আধা সিংহ আধা ড্রাগন। রাজার রক্ষী মনে করা হত এদের। বিপদে আপদে রাজাকে রক্ষা করা ছিল কাংলা শা—দের কাজ। সানামহি ধর্মপালনকারী মেইতেইদের পবিত্রতম স্থান এই কাংলা। মণিপুরের অন্যতম ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য তো বটেই। কারণ, রাজ্যটির ভিত্তিভূমিই ছিল এই কাংলা। এর ইতিহাস খ্রিস্টপূর্বাব্দ প্রাচীন। ১৮৯১-এর মার্চে অ্যাংলো-মণিপুর যুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হয় প্রাসাদটি। রাজসিংহাসনের হাল ধরা সেনাপতি টিকেন্দ্রজিতের ফাঁসি হয় সেই বছরের আগস্ট নাগাদ। শোনা যায়, তাঁর শাস্তি মকুবের পত্র যথাসময়ে ব্রিটিশ রাজধানী কলকাতা থেকে ইম্ফলে পৌঁছে গেলেও তা বাক্সবন্দি হয়েই পড়েছিল। প্রকাশ্য আসে ফাঁসির পর। অসংখ্য প্রজাবেষ্টিত যেই জায়গাটায় জনসমক্ষে টিকেন্দ্রজিতের ফাঁসি হয়েছিল, সেখানে তাঁর সম্মানে পরবর্তীতে সৌধ গড়ে উঠেছে। ব্রিটিশ আধিপত্যকায়েমির সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে ও নষ্ট হয়ে যায় প্রাচীন মণিপুরি ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধর্মবিশ্বাস সংক্রান্ত একাধিক পুঁথিপত্র। গল্প শোনাতে শোনাতে ভারী হয়ে উঠেছিল মালেমের গলা। চোখ ছলছল। বুঝলাম, নিজেদের ঐতিহ্যসন্ধানী এই তরুণী বাকি সনামহি মেইতেইদের মতোই ইংরেজদের মাফ করতে পারেনি।
ইমা কৈথাল
খোওয়াইরামবান্দ বাজার। মেইতেই ভাষায় ‘ইমা’ অর্থ মা, ‘কৈথাল’ মানে বাজার। অর্থাৎ, মায়েদের দ্বারা পরিচালিত বাজার। বিশ্বের একমাত্র মহিলা পরিচালিত বাজার এটি। শুনে চমকে গিয়েছিলাম, চাক্ষুষে বমকে গেলাম! ষোড়শ শতকে এই বাজারের নির্মাণ। ইতিহাস বলে, চিনা ও বর্মিদের সঙ্গে যখন যুদ্ধে ব্যস্ত মণিপুরি পুরুষরা, তখন রাজ্যের মধ্যেকার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার হাল ধরেছিলেন মহিলারাই। আগেই বলেছি, সেভেন সিস্টার স্টেটস—এ এক্সএক্স ক্রোমোজমের দাপট। কৈথালে হাজার কিসিমের জিনিসের পসরা সাজিয়ে প্রাচীনা-নবীনারা। মাথায় তিলক, গায়ে ফানেক আর ইন্নাফি। তিলকচর্চিত, সদা হাস্যময়ী মুখ। তাঁদের কাঁধেই ন্যস্ত একটা গোটা রাজ্যের বাণিজ্য ও অর্থনীতির ভার। এমন একটা রাজ্য, তাও খোদ আমাদেরই দেশের– ভাবতে অবাক লাগে!
তবে দেখে আক্ষরিকই অবাক হয়েছিলাম। ছোট ছোট সাতটা বাজার নিয়ে গোটা ইমা কৈথাল। বলা বাহুল্য, কর্ণধার মহিলারাই। মূল
বিল্ডিংয়ে জামাকাপড়ই বেশি কেনাবেচা হচ্ছে। তাছাড়াও রয়েছে পুজোআচ্চার সামগ্রী, গামছা, বাসনকোসন, গয়নাগাটি, খাওয়াদাওয়ার স্টল। মূল বিল্ডিংয়ের বাইরেও প্রচুর বাজার আর স্টল। এবং অবশ্যই সেখানেও মহিলা বিক্রেতাদের রমরমা। বিক্রি হচ্ছে শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি। আর সঙ্গে হাজার মাছের রমরমা। মোস্টলি মাছভাজা। মৎস্যজীবী পুরুষেরা লোকটাক থেকে মাছ ধরেন। তাঁদের কাছ থেকে সেইসব মাছ বাজারে নিয়ে আনা ও বিক্রি করার দায়িত্ব থাকে মেয়েদের উপর। চণ্ডীদাসের রামী হয়ে নেই এখানকার মহিলারা। অর্ধেক আকাশে হেঁটে চলেছেন পুরুষদের পাশাপাশি। তাঁদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
সেই বৈকালিক আকাশের ছায়াই এসে পড়ছিল গাড়ির কাচে। ছেড়ে চলে আসার বিকেল। মনখারাপের বিকেল। দূরে যাওয়ার বিকেল।
যতটা দূরে গেলে দূরত্বের পরিমাপ করতে ইচ্ছে করে না। ফিরে আসার জন্য মনকেমন করে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.