তরুণকান্তি দাস: বাঙালির মন মজেছে পাহাড়ে। ঘরের কাছে নিজের প্রিয় দার্জিলিং বা গ্যাংটক তো বটেই, এবার সবার ছুট কাশ্মীর, হিমাচলে। বহুদিন পর লম্বা ছুটিতে ঘরের বাইরে পা রাখার সুযোগ মিলছে। সেই সুযোগ নষ্ট না করে পায়ের তলায় সরষে থাকা বাঙালির নজরে ডাল লেক, শিমলার ম্যাল বা মানালি। তথ্য বলছে, এবার গত দশ বছরের মধ্যে রেকর্ড ভিড় টানছে কাশ্মীর। তারপর হিমাচল। আর আমাদের প্রিয় দার্জিলিং ও সিকিম রুট? সেখানে গরমের ছুটির সময় হাউসফুল। ডুয়ার্সে বুকিং প্রায় ৬০ শতাংশ শেষ। আর দিঘা, মন্দারমণি, তাজপুর সার্কিটে এখনও যে সংখ্যক পর্যটক নিয়মিত যাচ্ছেন, তার ভিত্তিতেই সেখানকার হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের ধারণা, গরমের ছুটিতে ‘নো রুম’ বোর্ড ঝোলাতে হবে প্রায় সব হোটেলেই। তবে গরমে পুদুচেরি ছাড়া দক্ষিণ ভারতের কেরল বা কন্যাকুমারিকার মতো জায়গার দিকে ততটা পা বাড়াচ্ছে না বাঙালি।
করোনা তো বটেই, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও কাশ্মীরের পথে অনেকদিন তেমনভাবে পা বাড়ায়নি বাঙালি। কিন্তু এবার হঠাৎ করেই যেন সেখানে যাওয়ার জন্য হিড়িক পড়ে গিয়েছে। ট্রেন তো বটেই, বিমানেও আসন সংকট। চাহিদা বেশি থাকায় চড়চড়িয়ে বাড়ছে উড়ান ভাড়া। এমনিতেই কলকাতা থেকে সরাসরি উড়ান নেই। তাতে কী? টিকিটের চাহিদা অনেক বেশি। কাশ্মীর পর্যটনের কলকাতার দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিকর্তা এহসান উল হক বলেছেন, “আমরা পর্যটকদের কাছে পুরনো দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে চাই। এমনিতে এবার অনুকূল আবহাওয়ায় প্রচুর টিউলিপ হওয়ায় প্রকৃতির সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। আমরা বিভিন্ন পর্যটন সংস্থার সঙ্গে গত কয়েকমাস ধরে ওয়েবিনারের মাধ্যমে পরিস্থিতিটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। এবার বাংলা থেকে যে সংখ্যক পর্যটক যাচ্ছেন তা গত ১০ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেবে। এখনই প্রতিদিন গড়ে দু’হাজারের বেশি বাঙালি কাশ্মীরমুখী। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে, অর্থাৎ গরমের ছুটি পড়লেই এটা ১০ গুণ বেড়ে যাবে দিন পনেরোর জন্য। ওই সময় হোটেল বুকিং না করে গেলে কিন্তু বিপাকে পড়তে হবে। এখনই ডাল লেকের কাছে কোনও হোটেলের বুকিং মিলছে না। সবই ভরা।” টুরিজম অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের প্রাক্তন কর্তা বাচ্চু চৌধুরির বক্তব্য, “২০১২ সালের পর এত পর্যটক কাশ্মীরে যাচ্ছেন।”
একই অবস্থা হিমাচল টুরিজমেরও। কালকা মেলের টিকিট আর লটারি এখন সমার্থক। যাঁরা কালকায় নেমে টয়ট্রেনে শিমলা যেতে চান মে মাসের কোনও সময়ে, তাঁদের সেই আশা ত্যাগ করাই ভাল। শিমলার ম্যালের কাছাকাছি হোটেল পাওয়া যাচ্ছে না। এমনিতেই এখন যানজট শিমলার সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। তাই পর্যটকদের গাড়ি যাতায়াতেও বিশেষ নীতি চালু করেছে সেখানকার সরকার। কলকাতার হিমাচল পর্যটনের এক কর্তা বলেছেন, “গরমের ছুটিতে বাঙালির শিমলার ম্যালে যাওয়ার একটা নস্টালজিক টান থাকেই। তবে এবার খাজিয়ারের বুকিং যথেষ্ট। আর ডালহৌসির দিকে যাওয়ার প্রবণতা বোধহয় বাড়িয়ে দিয়েছেন দলাই লামা। নাহলে বাড়তি সময় ও খরচের তোয়াক্কা না করে চিরকালীন শিমলা, কুলু, মানালি ছাড়াও বাঙালি ডালহৌসি যাচ্ছে কেন? যাঁরা যাচ্ছেন তাঁদের প্রতি পরামর্শ, গাড়ি বুকিং করতে চাইলে এখনই করে নিন। কারণ রোজই ভাড়া বাড়ছে।”
কিন্তু সমস্যা হল, কোনও পর্যটনকেন্দ্রের গাড়ির বুকিং আগাম করতে গেলেই বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন দর হাঁকছে। অনেকে আবার বুকিং নিলেও যাত্রা শুরুর তিনদিন আগের রেট মানতে হবে বলে চুক্তি করাচ্ছে। কারণ পেট্রোপণ্যের ঊর্ধ্বগামী দাম। দার্জিলিং, ডুয়ার্সের ছবিটাও একই। একটি পর্যটন সংস্থার কর্তা এবং পর্যটন সংস্থাগুলির সংগঠনের প্রাক্তন কর্মকর্তা নীলাঞ্জন বসুও এই সমস্যা মেনে নিয়ে বলেছেন, “এছাড়া তো কিছু করার নেই।” তিনিও জানিয়েছেন, কাশ্মীর এখন এক নম্বরে। তারপর হিমাচল। উত্তরবঙ্গ বা সিকিমের ঠান্ডা এলাকা তো চিরকালীন ‘হট’ গন্তব্য। সেখানেও ঘর পাওয়া দুষ্কর এখনই। ডুয়ার্সের লাটাগুড়ি হোটেল ও রিসর্ট অ্যাসোসিয়েশনের কর্তা দীপ্তেন্দু দে বলেছেন, “পয়লা বৈশাখের বুকিং যথেষ্ট আশাপ্রদ। আর গরমের লম্বা ছুটিতে একশো না হোক, ৮০ শতাংশ বুকিং হবেই।” লাটাগুড়িতে প্রায় ৭০টি রিসর্ট রয়েছে। লাভা, লোলেগাঁও, সান্তালখোলা ঘুরে অনেকেই ডুয়ার্সের লাটাগুড়ি বা মূর্তি অথবা বক্সা এলাকায় নেমে দু—চারদিন থাকতে চান। সর্বত্র এখনই যে হারে বুকিং আসছে, তাতে পর্যটন শিল্পে যুক্তরা খুশি। পায়ের তলায় সরষে রাখা বাঙালি ফের নিজস্ব মেজাজে। আর তার জোরেই গতি পাচ্ছে করোনা আবহে মুখ থুবড়ে পড়া পর্যটনশিল্প। এই মরশুমেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.