বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: বাঁশ-কাঠের তৈরি ‘নাকো-শা’ বিলুপ্তপ্রায়। বেড়েছে কংক্রিটের নির্মাণ। নেই ‘গাও বুড়ো’। বসে না গ্রাম পরিচালনার সভা ‘লাচি-জাংওয়া’। পর্যটন শিল্পে হাত পাকিয়ে এখন অনেকটাই আধুনিক দেশের ক্ষুদ্রতম জনজাতি উত্তরের টোটো সমাজ। রাজ্য সরকারের উৎসাহে নিজেরাই হোম-স্টে (Home Stay) খুলে বিকল্প রোজগারের পথ খুঁজে নিতেই অভাবনীয় সাড়া পাচ্ছেন তাঁরা। একই সঙ্গে টোটোপাড়ার হাত ধরে উত্তরে আত্মপ্রকাশের পথে ‘এডুকেশনাল অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম’-এর নয়া দিগন্ত।
দু’দশক আগেও অধুনা আলিপুরদুয়ার (Alipurduar) জেলার মাদারিহাট ব্লকের টোটোপাড়া ছিল পূবে তোর্সা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে হাউরি নদী ঘেরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একটি গ্রাম মাত্র। উৎসাহী গবেষকদের বাইরে ভুটান সীমান্তের তাদিং পাহাড়ের কোলে জলদাপাড়া থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের ওই জনপদে বাইরের লোকজনের তেমন যাতায়াত ছিল না। এমনকি পর্যটকদেরও দেখা মেলেনি। পাহাড়ি গ্রামে পঞ্চায়েতগাঁও, মণ্ডলগাঁও, সুব্বাগাঁও, মিত্রংগাঁও, পূজাগাঁও এবং ধুমচিগাঁও নামে ছটি পাড়া রয়েছে। সেখানেই ওদলা গাছের ছালের দড়িতে বাধা বাঁশের মাচার উপর কাঠে তৈরি ‘নাকো-শা’ নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত ঘরে টোটোরা বসবাস করতেন। জীবিকা বলতে ছিল কৃষিকাজ ও পশুপালন। সামান্য কিছু কমলালেবু (Orange) চাষও হয়েছে।
সময়ের সঙ্গে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ পালটাতে শুরু করলে এক সময় টোটো (Toto) জনজাতি বিলুপ্তির পথে দাঁড়ায়। পদ্মশ্রী ধনীরাম টোটো জানান, ১৯৫১ সালে জনসংখ্যা কমে হয়েছিল ৩২১ জন। এরপর কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বিশেষ কিছু পদক্ষেপ করায় ২০০১ সালে সংখ্যা বেড়ে হয় ১১৮৪ জন। এখন ১৬০০ জন টোটো রয়েছে। শুধু যে খাদের কিনারে থেকে জনসংখ্যায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে টোটোরা সেটাই নয়। অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে ওই জনজাতির মানুষরা সাবেকিয়ানা ছেড়ে আধুনিক হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। বেড়েছে উচ্চশিক্ষার ঝোঁক। বিকল্প পেশা হিসেবে পর্যটনশিল্প বেছে নিতে শুরু করেছে নতুন প্রজন্ম। টোটোপাড়া জুড়ে মাথা তুলেছে কংক্রিটের বাড়ি। গড়ে উঠেছে ২৬টি হোমস্টে। বছরভর পর্যটকের আনাগোনা লেগেই আছে। কিন্তু কোন ম্যাজিকে এমন পরিবর্তন?
স্থানীয় বাসিন্দা ভবেশ টোটো জানান, পাঁচ-ছয় বছর থেকে টোটোপাড়ায় পর্যটন শিল্প বিকাশের ভাবনা গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। রাজ্য সরকার হোম-স্টে তৈরির জন্য উৎসাহ দিয়েছে। ঘরবাড়ি তৈরি করতে সাহায্য করেছে। প্রয়োজনীয় আসবাব-পত্র সহ বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। কার্যত এর পরই পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে। ভবেশবাবু বলেন, “এখানে পানীয় জলের সমস্যা মিটলে হোম-স্টের সংখ্যা বাড়বে। এখন ২৬টি হোমস্টের মধ্যে ২৫টি টোটো পরিবারের। জলের সমস্যার জন্য অনেকে ঠিক মতো চলাতে পারছে না।”
সমস্যার কথা জানেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান মৃদুল গোস্বামী। তিনি বলেন, “টোটোপাড়াকে কেন্দ্র করে ‘এডুকেশনাল অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম’ বিকাশের সব চেষ্টা চলছে। সেখানে পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।” এদিকে রাজ্য সরকারের ইকো ট্যুরিজম (Eco tourism) বিভাগের চেয়ারম্যান রাজ বসু আরও বেশি পর্যটক টানতে টোটোপাড়ায় একটি মিউজিয়াম তৈরির প্রস্তাব রেখেছেন। তিনি বলেন, “টোটোদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী সংরক্ষণ করে ওই মিউজিয়াম গড়ে তোলার জন্য আলোচনা চলছে। সেটা হলে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.