সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: “টুসুমনি আসছে চৌডলে, তোরা মনের কথা বলে লে।” ইউটিউব থেকে সামাজিক মাধ্যমের দাপট যতই থাক। আজও মুখে মুখে হারিয়ে যায়নি টুসু গান। আসলে টুসু গান যে আন্দোলনেরও অস্ত্র! সাবেক মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সেই প্রতিবাদী গান, ” শুন বিহারি ভাই, তোরা রাইখতে লারবি ডাঙ দেখাই / তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি, বাংলা ভাষায় দিলি ছাই….। ” আজও কানে কানে বাজে সাবেক মানভূম তথা বিস্তীর্ণ ছোটনাগপুর মালভূমিতে। সেই ভূমে মকর পরবে টুসু মেলা তো রঙিন হবেই। সঙ্গে আছে যে মানভূমের গুড় পিঠে থেকে পাটিসাপটা, দুধ পুলি, মুগ পুলিও। থিকথিকে পর্যটকের ভিড়ে অযোধ্যা পাহাড়ে যে ‘পৌষ পার্বণ’ নাম দিয়ে একটি চারতারা রিসোর্ট পিঠে-পুলির আয়োজন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সবে মিলিয়ে টুসুমনিকে ঘিরে জমজমাট জঙ্গলমহলের কালচারাল ট্যুরিজমও।
তাই সোমবার মকর সংক্রান্তির সকাল থেকেই সমগ্র পুরুলিয়া যেন গাঁ-গঞ্জের জলাশয়মুখী হয়। ৫.৫ ডিগ্রি সর্বনিম্নে মরশুমের শীতলতম দিনে মকর ডুব হয় কাঁসাই থেকে সুবর্ণরেখায়। কুমারী থেকে শীলাবতিতেও। সেই সঙ্গে সকাল থেকে টুসু গান গেয়ে গেয়ে এই পরবের প্রধান উপকরণ চৌডল নিয়ে জলাশয়ে চলে ভাসান। “জলে
হেল, জলে খেল/ জলে তুমার কে আছে?/ ভালো কইরে ভাইবে দেখো/ জলে শ্বশুর ঘর আছে। ” রঙবাহারি চৌডলে যেন আরও রঙিন হয়ে যায় এই উৎসব। মানভূম কালচারাল আকাদেমি ও পুরুলিয়া জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের আয়োজনে পুরুলিয়া শহরের উপকন্ঠে শিমুলিয়ায় কাঁসাই নদীর পাড়ে টুসু পরব যেন আলাদা নজর কাড়ে। টুসু গীত থেকে চৌডল প্রতিযোগিতায় ভিড় উপচে পড়ে। এই উৎসবেই প্রকাশিত হয় রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের আওতায় থাকা মানভূম কালচারাল আকাদেমির ‘ মানভূমের টুসু পরব’ পুস্তক। যেখানে মানভূমের প্রাণের উৎসব টুসুকে দুই মলাটে বন্দি করা হয়েছে।
আড়শায় কাঁসাই নদীর তীরে দেউলবেড়া ( দশগ্রাম ) মেলা কমিটি তাদের টুসুমেলায় গাছ লাগিয়ে পরিবেশবান্ধব বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জন, নেশা দ্রব্য থেকে দূরে থাকা, ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’-র প্রচার ব্যানারের মাধ্যমে তুলে ধরে সচেতনতার বার্তা দেয়। পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি গবেষক জলধর কর্মকার বলেন, ” পুরুলিয়া তথা সাবেক মানভূমের লোকজীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের জীবনকাহিনী সব থেকে বেশি ধরা পড়ে যে গানে তা হল টুসু । দুর্গা পুজো যদি বাঙালির জাতীয় উৎসব হয় তাহলে পুরুলিয়া তথা মানভূমের জাতীয় উৎসব অবশ্যই টুসু। প্রকৃত অর্থেই টুসু উৎসব এ জেলার মহামিলনের পরব। ” তাই অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদেরকে আরও মাটির কাছাকাছি নিয়ে যেতে অযোধ্যা হিলটপের কচুরিরাখায় একটি চারতারা রিসোর্ট ‘পৌষ পার্বণ’ উৎসবের আয়োজন করেছে। তাদের একটি রেস্তোরাঁয় ১২ই জানুয়ারি থেকে ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত নলেন গুড়ের পাটিসাপটা, দুধপুলি পিঠা, পুয়া পিঠা, চসির পায়েস, নকসি পিঠে, রসবড়া, নলেন গুড়ের পায়েস , কোলার বড়া, ভাজা মুগ পুলি, সরভাপা পিঠে, ক্ষীরপুলি, পান পিঠা, সরু চখলি মিলবে। এখানকার শেফ চম্পা দাস বলেন, “আমাদের এই ‘পৌষ পার্বণ’- এ আমরা সব রকম পিঠের আয়োজন করেছি। মানভূমের বিশেষ বিশেষ পিঠের সঙ্গে পাটিসাপটা, দুধ পুলি, ভাজা মুগ পুলির মত পিঠে আছে। পৌষ পার্বণের এই উৎসব আমাদের ৩১ শে জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে।” এই উৎসবে ওই রেস্তোরাঁয় ভেজ এবং নন-ভেজ থালিও থাকছে। সবে মিলিয়ে সাবেক মানভূম তথা পুরুলিয়ায় জমজমাট টুসু পরবে এদিন ছিল একেবারে অলিখিত বনধ। শহরের দোকানপাট ছিল একেবারে বন্ধ। শহর যে হয়েছিল জলাশয়মুখী। তবে এদিনই শুধু নয়, ১ লা মাঘ আখান যাত্রা সহ আরও কয়েক দিন ছুটির আমেজে মেলাতেই ডুবে থাকবে এই মালভূমির জনপদ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.