পুজোর ছুটি মানেই শুধু হইচই, ঠাকুর দেখা, রেস্তোরাঁয় ভূরিভোজ নয়, বাঙালির একাংশ এই সময় বেরিয়ে পড়ে কয়েকটি দিন নিরিবিলিতে কাটিয়ে শরীর-মন চাঙ্গা করে নিতে। তাই অফবিট ডেস্টিনেশন হিসাবে বেছে নিতেই পারেন পাহাড়ি শান্ত জনপদ বারামানজিন, দিলারাম, পাবং, গীতখোলা, সুনতালে, রিকিসুম অথবা বিদ্যাং ভ্যালি। কী আছে সেই পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে, পৌঁছবেন কেমন করে তার হদিশ দিচ্ছেন বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য।
বারামানজিন
পাইনের জঙ্গলে হারিয়ে যেতে মন চাইলে চলুন কালিম্পং জেলার ছোট্ট গ্রাম বারামানজিন। বছরভর এখানে শীত। মেঘের মতো রাশি রাশি কুয়াশা ভেসে বেড়াতে দেখে মন জুড়াবে। পাইনের জঙ্গলে নজর কাড়বে ঝাঁক বেঁধে ধনেশ পাখিদের হুটোপুটি। আরও কত অচেনা পাখি পেয়ে যাবেন কোলাহল মুক্ত এই জনপদে। এছাড়াও তো রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগের সুযোগ মিলবে। এখানে দাঁড়িয়ে নিচে গোটা ডুয়ার্স ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো লাগবে। জনসংখ্যা অতি সামান্য। তাই নিরিবিলি সময় কাটবে। এবারই প্রথম পুজোর আয়োজন হয়েছে গ্রামে। তাই বেড়াতে এসে দেবী দর্শন বাড়তি পাওনা। সম্প্রতি এখানে হোম স্টে তৈরি হয়েছে। তাই থাকার অসুবিধা নেই। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে বারামানজিন গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। সেখান থেকে ওদলাবাড়ি, পাথরঝোরা হয়ে পাহাড়ি পথ ধরে সহজে পৌঁছে যেতে পারবেন। ভাড়া ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকার মধ্যে। ফেরার জন্য বারামানজিন থেকে ভাড়া গাড়ি পেয়ে যাবেন। ফেরার পথে দেখে নিতে ভুলবেন না তিস্তা ব্যারাজ। মন চাইলে তিস্তা নদীপাড়ের কোনও হোটেলে বসে উত্তরের বিখ্যাত রুপোলি শস্য বোরলি মাছের রেসিপি দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিতে পারেন। পাশেই পেয়ে যাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের পর্যটনকেন্দ্র ‘ভোরের আলো’। সেখানে কিছুটা সময় কাটাতে মন্দ লাগবে না।
দিলারাম
আপনি কি নিরিবিলি সময় কাটানোর ফাঁকে দেখতে চান পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাণীদের অন্যতম স্যালামান্ডার! অথবা বিশ্বের সেরা চা উৎপাদন হয় যেখানে, সেই চা-বাগান! তবে অবশ্যই চলুন কার্শিয়াং পাহাড়ের জঙ্গল ও চা-বাগান ঘেরা দিলাররাম গ্রামে। এই পাহাড়ি উপত্যকায় হাতের কাছে মেঘ পেয়ে ঠিক মনে পড়বে কবি জয় গোস্বামীর ‘মেঘবালিকার জন্য রূপকথার জগৎ’। চোখের পলক পড়তে কখন শরীর ভিজিয়ে উড়ে যায় পেজা তুলোর মতো মেঘ! হাওয়ায় ভেসে জলকণা চুলের ডগায় আটকে মুক্তোর মতো ঝলমল করে দোল খায় ঠিক নেই। দিলারাম থেকে দশ কিলোমিটার দূরে পেয়ে যাবেন ভানজাং সালামান্ডার হ্রদ। এখানে দেখা মিলবে হিমালয় সালামান্ডারের। অবশ্যই ঘুরে দেখে নিন মার্গারেট’স হোপ টি এস্টেট। এখানেই বিশ্বের সেরা চা উৎপাদন হয়ে থাকে। দিলারাম থেকে ঘুরে নিতে পারেন মিরিক, রংবাং অথবা দার্জিলিং। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে দিলারামের দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। কার্শিয়াং থেকে ৮ কিলোমিটার। ভাড়া গাড়িতে সহজে পৌঁছে যেতে পারবেন। ভাড়া সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে। ফেরার সময় দিলারাম থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করতে পারেন। দার্জিলিং থেকে দিলারাম পর্যন্ত লোকাল ট্যাক্সিও চলে। এখানে রাস্তার পাশে ‘পথে সাথী’পেয়ে যাবেন, সেখানে থাকতে পারেন। অথবা গ্রামের ভিতরে হোমস্টে রয়েছে।
গীতখোলা
কালিম্পং জেলার এই পাহাড়ি জনপদের নামকরণে লুকিয়ে আছে রহস্য। চারদিক পাহাড়ঘেরা জনপদে পৌঁছে মন ফিদা হবে ঝরনার অদ্ভুত সংগীত মূর্ছনায়। সেজন্যই ছোট্ট গ্রামের নামকরণ হয়েছে গীতখোলা। যেদিকে তাকাবেন নজর কাড়বে উঁচু পাহাড় থেকে লাফিয়ে নামা ঝরনা। এক অনুভূতির জগতে পৌঁছতে সময় লাগবে না। পাইনের জঙ্গল ঘেরা জনপদে বসতি সামান্য। তাই কোলাহল মুক্ত। গ্রামে পৌঁছনোর পথে পেয়ে যাবেন চা বাগানের সবুজ গালিচা। ভাল লাগবে রকমারি পাখিদের কলতান। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে গীতখোলার দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। ভাড়া গাড়িতে ওদলাবাড়ি, পাথরঝোরা হয়ে সহজে পৌঁছে যেতে পারবেন। ভাড়া সাড়ে ৩ হাজার টাকার মধ্যে। ফেরার গাড়ি গীতখোলায় পৌঁছে ঠিক করে নিতে পারবেন। সম্প্রতি এই পাহাড়ি উপত্যকায় কয়েকটি হোমস্টে হয়েছে। এখান থেকে ফেরার পথেও আপনি পেয়ে যাবেন তিস্তা ব্যারাজ, রাজ্য সরকারের পর্যটনকেন্দ্র ভোরের আলো।
পাবং
কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোরম দৃশ্য উপভোগের জন্য চলুন এবার পুজোর ছুটিতে কালিম্পং জেলার পাবং গ্রামে। পাইনের জঙ্গলে ভরা সবুজ পরিবেশ। চারদিক পাহাড় ঘেরা ছোট্ট শান্ত জনপদ। এখানে ঘরে বসে নজরে পড়বে আকাশের নীল ক্যানভাসে তুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা। কালিম্পং থেকে অনেকটা উঁচুতে এই গ্রাম। তাই হিমেল আবহাওয়া। কালিম্পং শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। হিমেল হাওয়ায় ক্লান্তি জুড়াতে পাবংয়ের বিকল্প নেই। রকমারি প্রজাপতি, পাহাড়ি ফুল মুগ্ধ করবে। মন চাইলে এখান থেকে দিব্যি ঘুরে নিতে পারবেন লাভা, ললেগাও, রিশপ, চারখল পর্যটনকেন্দ্র। খুব বেশি বসতি নেই। পাবং থেকে লোলেগাঁওয়ের দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার। চারখোল ৪ কিলোমিটার। চারপাশে পর্যটন কেন্দ্র। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে পাবংয়ের দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিলোমিটার। সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে ভাড়া গাড়ি পেয়ে যাবেন। পৌঁছতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো। এখানে থাকার জন্য হোম স্টে পেয়ে যাবেন।
সুনতালে
আপনি যদি বিহঙ্গপ্রেমী হয়ে থাকেন তবে পুজোর ছুটিতে অবশ্যই আপনার গন্তব্য হওয়া উচিত সুনতালে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সুনতালে এবং সুনতালেখোলা মিলিয়ে দেবেন না। আপনি যাবেন কালিম্পং পাহাড়ের সুনতালে। পাইন, দেবদারুর জঙ্গলে নাম না জানা পাখিদের ওড়াউড়ি চলে দিনভর। সঙ্গে দূরবিন থাকলে সুবিধা হবে। রয়েছে এলাচ বাগান। সামান্য বসতি এলাকায়। তাই কোলাহল মুক্ত। এখনও হোম স্টে গড়ে ওঠেনি। এখানে বেড়াতে আপনাকে থাকতে হবে লাভা অথবা ঝান্ডিতে। লাভা থেকে সুনতালের দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। ঝান্ডি থেকে ৫ কিলোমিটার। সুনতালে থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখা যায়। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে সুনতালের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। ভাড়া গাড়িতে সহজে গরুবাথান হয়ে পৌঁছে যেতে পারবেন। ভাড়া ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকার মধ্যে।
রিকিসুম
ফুলপ্রেমীদের জন্য রইল ভ্রমণকেন্দ্রের ঠিকানা রিকিসুম। পাইনের জঙ্গলে ভরা কালিম্পং পাহাড়ের এই ছোট্ট জনপদ রকমারি ফুলে ভরা। বাড়তি পাওনা মেঘেদের হুটোপুটি। এখানে থেকে সূর্যোদয়ের অপরূপ দৃশ্য উপভোগের সুযোগ মিলবে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে কালিম্পং, আলগাড়া হয়ে রিকিসুম পৌঁছতে হবে। দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। ভাড়া গাড়িতে সহজে পৌঁছে যেতে পারবেন। ভাড়া ৪ হাজার টাকা। রিকিসুমে থাকার জায়গা বলতে কিছু হোম স্টে পাবেন।
বিদ্যাং ভ্যালি
কালিম্পং থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে সবুজ জনপদ বিদ্যাং ভ্যালি। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা এই উপত্যকা। চারদিক পাহাড় ঘেরা। উপত্যকা দিয়ে বয়ে চলেছে রেলি নদী। এখানেও মেঘেদের খুনসুটি নজর কাড়বে। বিদ্যাং ভ্যালিতে থেকে কালিম্পং শহরে কবিগুরুর স্মৃতি জড়িত গৌরীপুর হাউস, কালিম্পং আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট সেন্টার, বৌদ্ধ মনাস্ট্রি , ক্যাকটাস নার্সারি। ঘুরে দেখে নিতে পারেন। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে বিদ্যাং ভ্যালির দূরত্ব প্রায় ৮৮ কিলোমিটার। ভাড়াগাড়িতে সহজে পৌঁছে যেতে পারবেন। সাড়ে তিনঘণ্টার জার্নি। গাড়িভাড়া পড়বে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে। ফেরার জন্য পেয়ে যাবেন ভাড়াগাড়ি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.