তাপসকুমার দত্ত: কোচবিহার জেলার অন্তর্গত রসিকবিলের সবথেকে কাছের শহর আলিপুরদুয়ার৷ শিলিগুড়ি থেকে রসিকবিলের দূরত্ব প্রায় ২১২ কিলোমিটার, কোচবিহার থেকে ৪৫ কিলোমিটার এবং কাছের শহর আলিপুরদুয়ার থেকে দূরত্ব মাত্র ৩৪ কিলোমিটার৷
রসিকবিল ১৭৫ হেক্টর বিস্তৃত এক বিশাল প্রাকৃতিক ঝিল এবং এর আশপাশ জুড়ে রয়েছে প্রায় ৮০০ হেক্টরের বনভূমি৷ আদতে রসিকবিল একটি নিম্ন জলাভূমি৷
গত বছর শীতে বিকেল চারটে নাগাদ হালিশহর থেকে সবাই মিলে চলে গেলাম রসিকবিল৷ শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে চড়ে একরাত্রি ট্রেনে কাটানোর পর পরের দিন বেলা বারোটা নাগাদ আমরা আলিপুরদুয়ার পৌঁছালাম৷ এই ট্রেনে যাওয়ার বাড়তি মজা হল, ট্রেন যখন ডুয়ার্সের বনের মধ্যে দিয়ে যায়, তখন এর অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করা যায়৷ আর প্রতিটা সময় মনে হয়, এই বুঝি হাতির দল রেললাইন পারাপার করবে৷ সেটা ভাবতেই মনের মধ্যে একটা রোমাঞ্চ জাগে৷
স্টেশনে নামার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম ছোটখাটো চেহারার একটা মানুষ আমাদের সামনে এসে পরিচয় দিলেন, তিনিই হলেন শিবুনদা, যিনি আমাদের রসিকবিল দেখানোর গাইড হবেন৷ শিবুনদার কাছ থেকে জানতে পারলাম রসিকবিলের অনেক কথা– শুনতে শুনতে রসিকবিল ব্যাপারে আগ্রহ যেন আরও বেড়ে গেল৷
দুপুরের খাওয়াদাওয়া স্টেশনের কাছে একটা হোটেলে সেরে নিলাম৷ রসিকবিল সেখান থেকে অনেকটা পথ৷ ঠিক হল ওই পথেই কোচবিহারের রাজবাড়ি এবং মদনমোহন মন্দির একবার চোখের দেখা দেখে নেব৷
খাওয়াদাওয়া সেরে এবার আমরা একটা ভাড়া করা গাড়িতে উঠে বসলাম৷ এখান থেকে রসিকবিলের দূরত্ব প্রায় ৩৪ কিলোমিটার৷ এই পথে যেতে যেতে প্রথমে পড়ল কোচবিহারের রাজবাড়ি, তারপর মদনমোহন মন্দির৷ মদনমোহন মন্দির দেখে সোজা আবার চলা আমাদের গন্তব্যস্থলের দিকে৷ সন্ধে হবে হবে করছে, এরকম সময় আমরা রসিকবিলে এসে পৌঁছালাম৷ এখানেই আমাদের দু’রাত থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম৷
পরের দিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রস্তুত হয়ে রইলাম, কখন সূর্যদেবতা উঁকি মারবেন৷ আমরা যে বনবাংলোতে ছিলাম, তার পাশ দিয়ে গিয়েছে রসিকবিল৷ ভোরবেলায় এখানে সূর্যোদয়ের দৃশ্য অসাধারণ৷ তখনই শুরু হয়ে যায় পাখিদের কলতান৷ আমরাও আর ঘরে বসে রইলাম না৷ বিলের পাশ দিয়ে, বনের মধ্য দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম৷ এই রসিকবিলের আশেপাশে বহু উপজাতি বসবাস করে, তারাও এই সময় বেরিয়ে পড়ে জীবিকার সন্ধানে৷ মাছ ধরার কাজে বহু লোক রসিকবিলে আসে সকালবেলা৷
এছাড়া এখানে নৌকাবিহারের আনন্দই আলাদা৷ যাঁরা পাখির ছবি তোলেন, তাঁরা তো অবশ্যই নৌকা নেবেন৷ শীতের সময় এখানে প্রচুর পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে৷ আমরাও প্রচুর পরিযায়ী পাখির দেখা পেয়েছিলাম৷ যেমন শামুকখোল, অনেক ধরনের বক– যেমন কোচবক, বাচকা, হট্রিটি, বালুবাটান, পানকৌড়ি, চখাচখি ইত্যাদি৷ শীতকালে রসিকবিল হয়ে ওঠে পাখিদের স্বর্গরাজ্য৷ এছাড়া বনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আরও কতরকমের পাখির যে দেখা পেয়েছিলাম– যেমন বসন্তবৌরি, নীলকান্ত বসন্তবৌরি, খঞ্জন, দোয়েল, বুলবুল, নীলকণ্ঠ, মোহনচূড়া, সাইবেরিয়ান স্টোনচাট, মিনিভেট, নানারকমের মাছরাঙা, বাঁশপাতি, বাবুই, ফিঙে, বেনেবউ ইত্যাদি৷
এখানে একটা ছোট চিড়িয়াখানাও আছে, যেখানে হরিণ, ময়ূর, কুমির, চিতাবাঘ, কচ্ছপ, সাপ রয়েছে৷ বন উন্নয়ন নিগমের বাংলো ছাড়িয়ে কিছু দূরে গিয়ে দেখা যায় একটা সেতু৷ সেতু পার করেই দেখা যায় এই সমস্ত প্রাণীদের থাকার আলাদা ব্যবস্থা৷
সকালবেলা বেরিয়ে খেয়ালই করিনি কখন ঘড়িতে বারোটা বেজে গিয়েছে৷ আর দেরি না করে আমরা সবাই আবার বনবাংলোতে ফিরে এলাম৷ দুপুরের খাওয়াদাওয়া বনবাংলোতেই সেরে নিলাম৷ বনবাংলোর লোকদের আতিথেয়তা কোনওদিন ভোলার নয়৷ তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার বেলা তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম পাখির সন্ধানে৷ যদি কোনও নতুন পাখির সন্ধান পাওয়া যায়৷ কখন যে বেলা গড়িয়ে সন্ধে এসে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি৷ সূর্যদেবের অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এল৷ পাখিরা যে যার বাসায় ফিরে গেল৷ এখানে শীতকালে দিনের বেলাতে বহু লোক আসেন চড়ুইভাতি করতে৷ এবার আমাদের ফেরার পালা, শুধু রাত্রিটুকুর অপেক্ষা৷ সুযোগ পেলে আবার আসব এখানে পাখির মেলা উপভোগ করতে৷
কীভাবে যাবেন:
শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস ধরে আলিপুরদুয়ার স্টেশনে নামতে হবে৷ সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ৩৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে রসিকবিলে আসতে হয়৷
কোথায় থাকবেন:
বন উন্নয়ন নিগমের কতগুলো বাংলো এই রসিকবিলে আছে৷ এছাড়া যোগাযোগ করতে পারেন ট্যুরিজম সেন্টার (গভঃ অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল)-এ৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.