জিনিয়া সরকার: হাতে মাত্র ৫ দিন ছু্টি, কিন্তু মন চাইছে পাহাড়-জঙ্গলের মিলিত স্বাদ পেতে৷ দু’দিন পাহাড়, দু’দিন জঙ্গলের কম্বো ট্রিপ- ডেস্টিনেশন লাটাগুড়ি ও চিবো৷
শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে জলপাইগুড়ি বা এনজেপিতে না নেমে এগিয়ে গেলাম আরও একঘণ্টা পথ৷ মালবাজার স্টেশন৷ সেখান থেকে লাটাগুড়ি পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র ২০-৩০ মিনিট৷ এখানে শুধুই সবুজের সমাহার৷ কখনও সারি সারি বৃক্ষের ঘন জঙ্গল, কখনও আবার গাঢ় সবুজ কার্পেট বিছানো চায়ের বাগান৷ আছে আঁকাবাঁকা পথে বয়ে চলা নদীর কলতান, মাঝেমধ্যে আবার মেঘ ছুঁয়ে থাকা পাহাড়ের ইশারা৷ মনকে বোঝানো দায়৷ সবকিছু খুব কাছ থেকে অনুভব করতে চায়৷ প্রকৃতির টানেই পথচলা৷
লাটাগুড়িতেই সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা গরুমারা জাতীয় উদ্যান৷ গরুমারা জাতীয় উদ্যানে মোট পাঁচটি ওয়াচ টাওয়ার৷ যাত্রাপ্রসাদ, মেদলা, চুকচুকি, চন্দ্রচূড় ও চাপড়ামারি৷ জঙ্গলে গেলে দেখা মিলবে গন্ডার, হাতি, বাইসন, লেপার্ড, বিভিন্ন রকমের হরিণ, পাইথন, হনুমানের৷
মেদলা-তে মোষের গাড়িতে জঙ্গল সাফারি খুবই রোমাঞ্চকর৷ একদিকে চায়ের বাগান অন্যদিকে ঘন জঙ্গল, মাঝখানে সরু রাস্তা৷ মোষের গাড়িতে করে একরাশ আশা নিয়ে উদ্বিগ্ন চোখে চেয়ে থাকা, কখন দেখা যাবে হাতি কিংবা গন্ডার৷ সাপ, লেপার্ডের আতঙ্ক কিন্তু এড়ানো যাবে না৷ সাফারি শেষে দেখানো হয় ট্রাইবাল ডান্স৷ প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে আরও একাত্ম করতে চাইলে এটা মিস করা যাবে না৷ মেদলায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল জঙ্গলের গা দিয়েই বয়ে চলা মূর্তি নদী৷ যা মূর্তি ও জলঢাকা নদীর সংগমস্থল৷ সেখানে প্রায়ই হাতি ও গন্ডারের নদী পারাপারের দৃশ্য চোখে পড়ে৷
নানারকমের জন্তুজানোয়ারের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের পাখির কলতান শুনতে চাইলে অবশ্যই যেতে হবে চুকচুকিতে৷ যাত্রাপ্রসাদ, চুকচুকি, চন্দ্রচূড় ও চাপড়ামারিতে জঙ্গল সাফারি হয় জিপে চড়ে৷ প্রথমদিন লাটাগুড়ি পৌঁছে যে কোনও দু’টি ওয়াচ টাওয়ার ঘুরে নেওয়া যায়৷ তবে হ্যাঁ, মেদলা ১২ মাস খোলা থাকে, কিন্তু বাকি ওয়াচ টাওয়ারগুলো ১৫ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকে৷ পরের দিন প্ল্যান মূর্তি নদী, ঝালং, বিন্দু, সামসিং, সুনতালেখোলা, রকি আইল্যান্ড৷
লাটাগুড়ির জঙ্গলের গা ঘেঁষে বয়ে চলা মূর্তি নদীকে খুব কাছ থেকে পেলে মন্দ লাগে না৷ ছোট্ট নদী যা গরুমারা ন্যাশনাল পার্কের গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে এবং মিশেছে জলঢাকা নদীতে৷ নদীতে জলের গভীরতা খুবই কম৷ নদীর ঝকঝকে ঠান্ডা জলে পা ভেজানোর অনুভূতিই আলাদা৷ কিছুটা সময় মূর্তি নদীতে কাটিয়ে চাপড়ামারি জঙ্গলের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে চলে গেলাম ঝালং৷
জলঢাকা নদীর গা ঘেঁষে ছোট্ট গ্রামের নাম ঝালং৷ জলঢাকা নদীর ওপর অবস্থিত হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি প্রোজেক্ট ‘বিন্দু’৷ খুব কাছেই ভারত-ভুটান সীমান্ত৷ জলঢাকার ওপর এই হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি প্রোজেক্ট ভারত ও ভুটানের মধ্যে যোগস্থাপন করে চলেছে৷ জলস্রোত বরফের মতো শুভ্র, চারপাশের শান্ত, কোমল পরিবেশে জলঢাকার তীক্ষ্ণ গর্জন মনে ভয়ের আবেশ ঘটায় তবু মন মানে না, ইচ্ছে করে আরও কাছ থেকে দেখি, দেখেই যাই৷ প্রকৃতির ভয়াবহ সৌন্দর্য মন ছুঁয়ে যায়৷ মূর্তি নদী পেরিয়ে কিছু দূর যেতে চারপাশে চোখে পড়ে অসংখ্য রবার গাছ, এবং গাছ থেকে রবার চাষ পদ্ধতি বেশ কৌতূহলসৃষ্টি করে৷ ঝালং থেকে সামসিং হয়ে সুনতালেখোলা৷
সামসিং এমন একটি জায়গা যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখজুড়ানো৷ খুব শীতল, চিত্রানুগ স্থান৷ যেখানে চারপাশে শুধু চায়ের বাগান, মাঝে মাঝে বয়ে চলেছে ঝরনা, চা-বাগানের মাঝে একটা-দু’টো মাথা উঁচু করে থাকা গাছ, দূরে সবুজ পাহাড়, নীল আকাশ৷ ঠিক যেন ছবি৷ সৌন্দর্য পেরিয়ে পৌঁছলাম সুনতালেখোলা৷ সুনতালেখোলা একটা ছোট্ট ঝরনার নাম, তার ওপর এক অদ্ভুত ঝুলন্ত ব্রিজ৷ হাতে সময় থাকলে একদিন সেখানে থাকতেও পারেন৷ সামসিং থেকে ২ কিমি দূরে রকি আইল্যান্ড৷ সেখান থেকে মূর্তি নদী, জঙ্গল সমস্ত মিলিয়ে আবার প্রকৃতি তার রূপবদল করে হাজির৷
জঙ্গল, নদীর স্বাদ নিয়ে মন যখন পাহাড় ছুঁতে চায় পাড়ি দিলাম চিবো৷ লাটাগুড়ি থেকে তিন-চার ঘণ্টার পথ৷ সমতল ছাড়িয়ে পাহাড়ের কোলে ঠান্ডা-কোমল পরিবেশ, নির্জনতার ছোঁয়া পেতে পৌঁছলাম চিবো পাহাড়ে৷ কালিম্পং থেকে ৬ কিমি ওপরে৷ পাহাড়ের গায়ে নির্জন, নিরিবিলি ছোট্ট গ্রাম৷ চারপাশে শুধুই মেঘে ঢাকা পাহাড়, ঘন ঝাউয়ের জঙ্গল, বয়ে চলা ঝরনা, আর রংবেরঙের ফুল৷ এখান থেকে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ৷ ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন, কখনও ঘন কালো মেঘ, কখনও বৃষ্টি, কখনও আবার হালকা রোদ৷ জঙ্গল পেরিয়ে হালকা শীতে পাহাড়ের নির্জনতা একাকিত্বকে বরং দূরেই সরিয়ে দেয়৷ মনে স্মৃতির হাতছানি, কখনও আবার সকলে মিলে জমিয়ে আড্ডায় পাহাড় জমজমাট৷
পরের দিন সকালে সাইটসিয়িং৷ পাইনভিউ নার্সারি, হনুমান মন্দির, ডেলো হিল, দুরপিন দারা মনাস্ট্রি৷ পাইনভিউ নার্সারিতে হরেকরকম ক্যাকটাস, তাদের বিচিত্র গঠন৷ তারপর ৩০ মিনিট পথে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে গেলাম ডেলো পাহাড়ে৷ পাহাড়ের গায়ে ডেলো পার্কে ঝাউয়ের জঙ্গল, সাজানো বাগান, পার্ক থেকে পাহাড়ের শোভা সব মিলিয়ে অপূর্ব৷ এরপর হনুমান পার্ক ও দুরপিন দারা মনাস্ট্রি ঘুরে সন্ধেবেলা ফেরা৷ পরের দিন চিবো থেকে রওনা দিয়ে এনজিপি৷ সময় লাগে ৫-৬ ঘণ্টা৷ তবে হাতে যদি ছুটি বেশি থাকে কালিম্পং থেকে যাওয়া যায় গ্যাংটক, দার্জিলিং, চারধাম, লোলেগাঁও৷ পাহাড়, জঙ্গল মিলিয়ে অল্প ছুটিতে এই ছোট্ট ট্রিপ মন ভাল করতে বাধ্য৷
কীভাবে যাবেন: লাটাগুড়ি যেতে গেলে শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে নিউ মাল জংশন৷ অথবা যে কোনও ট্রেনে (পদাতিক, দার্জিলিং মেল, তিস্তা-তোর্সা) এনজিপি পৌঁছে সেখান থেকে গাড়িতেও লাটাগুড়ি যাওয়া সম্ভব৷
কোথায় থাকবেন: লাটাগুড়িতে থাকার জায়গা অনেক৷ থাকতে পারেন অরণ্য রিসর্ট-এ৷ জঙ্গলের কোলে এখানে থাকার ব্যবস্হা খুবই উন্নত ও নিরাপদ৷ জঙ্গলের সমস্ত রোমাঞ্চিত মুহূর্তের সম্মুখীন হতে চাইলে এই রিসর্ট সেরা৷ কালিম্পং-এ থাকুন চিবো ইন-এ৷ পাহাড়ের গায়ে একটা পুরো বাড়ি নিজেদের৷ পাহাড়ের নির্জনতায় সকলে মিলে নিজেদের মতো করে কাটানো যায়৷
কী খাবেন: লাটাগুড়িতে অবশ্যই খান বরোলি মাছ৷ তিস্তার জলে এই মাছ বড়ই সুস্বাদু৷ তবে দুর্লভও বটে৷ পেলে অবশ্যই খাবেন৷ চিবোতে পাহাড়ের হালকা ঠান্ডায় ধোঁয়া ওঠা মোমো, ফ্রায়েড চিকেন বেশ তৃপ্তিদায়ক৷
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.