গ্রীষ্মের দোসর। একটুকরো আমকথন। লিখেছেন বর্ণিনী মৈত্র চক্রবর্তী
আমের সিজন শুরু মানেই রসালো রহস্যের সূচনা। আম নিয়ে আমজনতার আদেখলাপনার শেষ নেই। সকাল, বিকাল, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার-সবেতেই আমের বাহার, আমচর্চা। একদিকে ডায়েট করে প্রায় খাওয়া ছাড়ার উপক্রম, কিন্তু আম দেখলেই নোলা লালায়িত। মনকে সান্ত্বনা দিতে সিজনাল ফ্রুটের গুণগান আওড়ানো।
শুধু খেলেই হবে না। আম কেমন করে খাওয়া হচ্ছে, সেটাও আলোচ্য। হাপুস হুপুস করে, না কি কাঁটা-চামচ দিয়ে কায়দা করে, না কি চাক করে কেটে-কেমন করে আম খাওয়া হচ্ছে, তা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাবটা এমন যেন আমের স্বাদ লেগে আছে খাওয়ার কায়দায়। শুধু কি তাই, কীভাবে আম পাড়া হবে, কোন আমকে তুলোতে মুড়ে রাখতে হবে, কোন আম কতক্ষণ জলে ভেজাতে হবে-সেও এক বিস্তর আলোচনার বিষয়। আসলে পরম যত্নে, সস্নেহে রাখতে হয় আমকে। তবেই তো তার রহস্য উন্মোচন করা যায়। শব্দের কৌলিন্যে যাবেন না, ধীরে ধীরে রস যখন ওষ্ঠ ছুঁয়ে জিভে এসে ঠেকে, তখন যে আনন্দের রসস্বাদনের অনুভূতি হয়, তা যে আম ভক্ষণ করে, সে-ই জানে।
এত যে প্রিয়, তাকে নিয়ে তো একটু-আধটু আদেখলাপনা করতেই হয়। নয়তো প্রণয়পর্ব জমবে কেমনে! যাইহোক একসময় আম কাটার যে ছুরি পাওয়া যেত, তা তৈরি হত বাঁশের, তালের, কাচের অথবা হাতির দাঁতের। আম নিয়ে স্তুতি, প্রশস্তির অন্ত নেই, তাই তো সে ফলের রাজা। আমের ও ভারতের ইতহাস এক। শ্রীপান্থ এক জায়গায় লিখছেন ‘কিছু কিছু ‘বকেয়া সাহেব’ চেষ্টা করেছিলেন বটে আমের জন্মভূমি ব্রহ্মদেশে ঠেলে দিতে। কেউ কেউ আরও পুবে-শ্যাম, কম্বোজ এবং মালয়ে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। পরবর্তী গবেষণায় জানা গিয়েছে- ‘ম্যাঙ্গো’ আসলে একটি তামিল শব্দের পরিবর্তিত রূপ। তামিল ভাষায় আমকে বলে ‘ম্যান-কে’ বা ‘ম্যান-গে’, তাই থেকে পর্তুগিজ ‘ম্যাঙ্গো’, এবং অবশেষে এই ইংরেজি ‘ম্যাঙ্গো’। সুতরাং ফলের রাজার জন্মভূমি ভারত।’
আম নিয়ে ভারতবাসীর প্রীতির পরিধি বহু বিস্তৃত। আর হবে নাই বা কেন। প্রখর দাবদাহে যখন জ্বালামুখীর রূপ ধারণ করে প্রকৃতি, তখন আমের সুমিষ্ট ঘ্রাণই মনে এক অপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে। আর তাই তো কালবৈশাখী এলে প্রথম চিন্তা হয়-এই রে, এবার বোধহয় সব আম পড়ে গেল। কালবৈশাখী তার নিজ নিয়মে উড়ে চলে, আমও তার নিজের ব্যক্তিত্বে সেজে ওঠে পশরায়, যেন কোনও মোহিনী, ঊর্ধ্বমুখী দরদামে যা থেকে যায় অধরা। আর এই মোহিনীমায়ায় আমবাঙালির গ্রীষ্মযাপন হয়ে ওঠে রোমান্টিক।
আম খাওয়ার যেমন আদবকায়দা আছে, আবার আম খাওয়ার নিয়মও আছে। গৃহদেবতাকে উৎসর্গ করে, গুরুজন, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ভাগ বাটোয়ারা করে তবে নিজের পাতে। এখন ম্যাঙ্গো ফেস্টিভালের তাগিদে পেটপুজোতেই আম উৎসর্গ। আম নিয়ে আলাপ আলোচনা যেমন অনন্তকাল ধরে চলতে পারে, আবার এ বিষয়ে রন্ধন পটীয়সীদের পারদর্শিতাও নজর কাড়ে। কাঁচা-পাকা দুই ভাগেই নানাবিধ অতি উপাদেয় সমস্ত ব্যঞ্জন সেই যুগযুগান্ত ধরে চলে আসছে। আমশি, আমপোড়ার শরবত, আচার তো আছেই আমের সহযোগে। রান্নার বৈচিত্র কিছু কম নয়। সারা পৃথিবীব্যাপী আম রাজত্ব করছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এ লেখার শেষে তাই যোগ করলাম কিছু আম রন্ধনপ্রণালী। যা আমের কিন্তু আম নয়।
এগলেস ম্যাঙ্গো মুজ
লাগবে- হুইপড ক্রিম ২৫০ গ্রাম, চিনির গুঁড়ো ১ কাপ, ভ্যানিলা এসেন্স কয়েক ফোঁটা, ম্যাঙ্গো পালপ ১ টা (বড়)।
প্রণালী-প্রথমে মিনিট পনেরো হুইপড ক্রিম একটা কাচের পাত্রে ঢেলে ফ্রিজারে রেখে দিন। এরপর বোলটা বের করে তাতে চিনি দিয়ে ফেটান। খুব সাবধানে ফেটাবেন। বেশি ফেটালে ফেটে যেতে পারে যাবে।
এরপর এর মধ্যে ভ্যানিলা এসেন্স আর আমের কাথ মিশিয়ে নিন ভাল করে।
কাঁচা আমের পপসিকল
লাগবে
চা আম ৩ টে (বড়), জল ১১/২ লিটার, চিনি ১/২ কেজি, গোলাপজল ২ টেবিল চামচ।
প্রণালী- প্রথমে কাঁচা আম পুড়িয়ে নিন। এরপর ছাঁকনিতে আম চটকে নিন জল দিয়ে। এইভাবে সমস্ত কাথ বার করে নিন। এবার এতে চিনি মিশিয়ে দিন। ভাল করে গুলে গোলাপজল মিশিয়ে দিন। পপসিক্ল মোল্ডে ঢেলে জমতে দিন।
মটর ডাল আর আমের টক
লাগবে-মটর ডাল ১০০ গ্রাম, সরষের তেল ভাজার জন্য, কাঁচা আম ৩ টে, শুকনো লঙ্কা গুঁড়ো ১ চা চামচ, গোটা সরষের গুঁড়ো ৩ চা চামচ, হলুদ ২ টেবিল চামচ, নুন স্বাদমতো, চিনি স্বাদমতো।
প্রণালী- প্রথমে মটর ডাল বেটে বড়া বানিয়ে নিন ছোট ছোট। এরপর আমের খোসা ছাড়িয়ে ছয় ফালি করে কেটে নিন। এবার কড়াইতে তেল গরম করে তাতে গোটা সরষে, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন। আমের টুকরো দিয়ে দিন। এরপর নুন-চিনি দিয়ে ভাজতে থাকুন। আমগুলো ভাঙা ভাঙা হলে এতে লঙ্কা, সরষে আর হলুদ গুঁড়ো দিয়ে নাড়াচাড়া করুন। বড়াগুলো দিয়ে দিন। অল্প একটু জল দিয়ে ফুটতে দিন। গা-মাখা হয়ে গেলে নামিয়ে নিন।
আমের মোরব্বা
লাগবে-কাঁচা আম ১ কেজি, জল ২ গ্লাস, লেবুর রস ১১/২ চা চামচ, চিনি ১১/২ কেজি, বাদাম (কাঠখোলায় ভাজা) ২ টেবিল চামচ, এলাচের দানা অল্প।
প্রণালী- প্রথমে আম ধুয়ে লম্বা লম্বা স্লাইস করে নিন। কাঁটা-চামচ দিয়ে একটু ফুটো ফুটো করে নিন। এরপর একটা নরম সাদা কাপড়ে আমগুলো দিয়ে মিনিট পাঁচ-সাতেক ফুটন্ত জলে ফুটতে দিন। হয়ে গেলে একদম জল ঝরিয়ে শুকনো করে নিন।
এবার আমসেদ্ধ করা জলে চিনি আর লেবুর রস মিশিয়ে রস করে নিন। হাতে যখন তার তার উঠবে, বুঝবেন রস হয়ে গিয়েছে। রসের গাদ ফেলে দিয়ে আমগুলো দিয়ে দিন। সেদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে নিন। এই অবস্থায় ১২ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে।
এরপর আম রস থেকে তুলে একটা কাপড়ে এলাচ দানা আর আম দিয়ে আবার ফোটান। মিনিট দুয়েক পর এলাচ দানা ফেলে আম আর বাদাম আবার রসে দিয়ে দিন। ঠান্ডা হয়ে গেলে কেওড়ার জল দিয়ে কোনও এয়ার টাইট কৌটোতে তুলে রাখুন। ২-৩ ঘণ্টা ফ্রিজে রেখে সার্ভ করুন আমের মোরব্বা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.