শিরদাঁড়ার সঙ্গে বিনুনি বেঁধে নার্ভের বিস্তার শরীর জুড়ে। যে কোনও সময় হাড়ের ব্যথা থাবা বসায় নার্ভে। কখনও হাঁটাচলা করতে কষ্ট। শিরদাঁড়া থেকে অসুখের উৎসের চিকিৎসা কীভাবে? কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের বিশিষ্ট নিউরোসার্জন ও স্পাইন বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিস্টোফার জার্ভার-এর কাছে খোঁজ নিলেন জিনিয়া সরকার।
রোগী : খুব জ্বলছে। সারা শরীরে যেন কেউ লঙ্কাবাটা লাগিয়ে দিয়েছে।
ডা. ক্রিস্ট: কবে থেকে হচ্ছে?
রোগী : বেশ কিছুদিন জ্বরে ভোগার পর মাস ছ’য়েক আগে কাশতে কাশতে হঠাৎ একদিন কাঁধে, দুটো হাতে অসহ্য যন্ত্রণা হতে শুরু করল। কারেন্ট লাগার মতো সব চিনচিন করছিল। এখন হাত-পায়ে অসহ্য ব্যথা। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর উঠে দাঁড়ালেই শরীর কাঁপছে। হাঁটতে গেলে টলমল। প্রথমে এক নিউরোলজিস্টের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বললেন, আমার অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার থেকে এমন সব সমস্যা হচ্ছে। তাঁর ওষুধে কোনও কাজ হল না। তখন এমআরআই স্ক্যান করতে বললেন। রিপোর্ট দেখে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে ডাক্তারবাবু। সোজা হয়ে আবার হাঁটতে পারব তো?
ডা. ক্রিস্ট: আপনার রিপোর্ট বলছে, সমস্যাটা আসলে শিরদাঁড়ায়। ঘাড়ের কাছে শিরদাঁড়া ড্যামেজ হয়েছে। এতটাই খারাপ অবস্থা যে, সেই স্থানের নার্ভেও মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। ঠিকমতো কাজ করছে না। তাই ব্যালান্স হারিয়ে ফেলছেন।
এই কথোপকথন হচ্ছিল ৪৮ বছরের বিমল ত্রিপাঠীর (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে ডা. ক্রিস্টোফারের। তাঁর সমস্যা শুনে ডাক্তারবাবু জানালেন, অপারেশন ছাড়া কোনও উপায় নেই। এমন সমস্যা অনেকেরই হয়। পরিস্থিতি অপারেশন পর্যন্ত যাতে না যায় তাই সাবধান।
কম-বেশি সবার কষ্ট
মাথা থেকে সমস্ত নার্ভ শিরদাঁড়া দিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। যা সব অঙ্গের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই শিরদাঁড়া কোনও কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব নার্ভ বা স্নায়ু অবধি যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। বিশেষ করে ব্যথা অবহেলা করলে কখন তার প্রকোপ স্নায়ুতে পড়বে কেউ বলতে পারে না।
অল্পবিস্তর ঘাড়ে ব্যথা প্রায় সকলেরই থাকে। একটু সোজা হয়ে শুয়ে-বসে ও পরিচিতের মুখে এক্সারসাইজের ফুলঝুরি শুনে, সেই মতো মুশকিল আসানের চেষ্টা করেন অনেক রোগী। এতে ক্ষণিকের সমাধান হয়। কিন্তু মাঝেমাঝেই চিনচিনে ব্যথা হয়, ঘাড়ের কাছে ভার হয়ে থাকে। স্পন্ডিলোসিসের সমস্যা বোঝা মুশকিল। তার চেয়েও জটিল, কখন সেই সমস্যা থেকে নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বুঝতে পারা।
যাঁরা সারাক্ষণ একটানা বসে কাজ করেন, ভারী জিনিস বহন করেন, তাঁদের বয়সকালে স্পন্ডিলোসিসের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। এই ব্যথা বেশি হয় কোমর ও ঘাড়ে। ঘাড়ের কাছে শিরদাঁড়ার ক্ষতি হলে নার্ভে প্রভাব বেশি পড়ে। আসলে শিরদাঁড়ার হাড়ে অস্বাভাবিক চাপ থেকেই স্পন্ডিলোসিসের কষ্ট শুরু হয়। এই হাড়ের মাঝে অসংখ্য ডিস্ক থাকে। হাড়ে চাপ পড়লে ডিস্ক সরে বা ঘুরে গিয়ে অবস্থার পরিবর্তন হয়, অথবা চাপ পড়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে আসে। যার চাপ শিরদাঁড়ার মধ্যে থাকা স্নায়ুর উপরও পড়ে। ক্রমশই এমন হতে হতে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাথা ঘোরা, হাত-পায়ে ব্যথা হওয়া থেকে শুরু করে সমস্যা বাড়তে বাড়তে ক্রমশই শরীরের ব্যালান্স হারাতে থাকে।
ব্যথা যখন স্নায়ুর অসুখ
শরীরের সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে শিরদাঁড়ায়। মাথার ভার পুরো বহন করে এটি। ভারী মাথা, তার সঙ্গে বসা, হাঁটাচলার অস্বাভাবিক ধরনের কারণে শিরদাঁড়ায় ব্যথা হয়। তবে ঘাড়ের স্পন্ডিলোসিস খুব বেড়ে স্নায়ুতে প্রভাব ফেললে দুই হাতে খুব যন্ত্রণা হয়। প্রস্রাব করতে ও মলত্যাগে অসুবিধা হয়। হাত পা ঝিনঝিন করতে থাকে ও কাঁপে। হাত-পা ও বুকের নিচ থেকে শরীরের বাকি অংশ ধীরে ধীরে অসাড় হতে থাকে। তবে ঘাড়ের চাপ স্নায়ুতে পড়লে তার প্রকাশ সবসময়ই যে খুব ব্যথা হবে তা নয়। সে ক্ষেত্রে হালকা ব্যথা, ঘাড়ে টানটান ভাব, শক্ত হয়ে থাকতে পারে। তবে কোমরের দিকে ব্যথা থেকে সমস্যা হলে, সেই ব্যথা কোমর থেকে পায়ের দিকে যাবে। সায়াটিকা বা বাতের ব্যথার মতো যন্ত্রণা হতে থাকবে। খুব বাড়াবাড়ি হলে পা অসাড় হয়ে প্যারালাইসিসও হয়ে যেতে পারে।
সাঁড়াশি আক্রমণ
দুর্ঘটনায় পিঠে, কোমরে চোট পেলে তা থেকে শিরদাঁড়ার ক্ষতি অনেক সময়ই স্নায়ুর সমস্যা ডেকে আনে। আচমকা ঘাড়ের কাছে আঘাত পেলে খুব সাবধান। এখানেই ব্রেন থেকে সমস্ত স্নায়ু এসে শিরদাঁড়ায় যুক্ত হয়।
এছাড়া টিউবারকিউলোসিস যদি ঠিকমতো না সারে তখন সেই ভাইরাস থেকে ইনফেকশন ছড়িয়ে শিরদাঁড়ায় যায়। শিরদাঁড়া ক্রমশই শিথিল হয়ে পড়ে। যা থেকে নার্ভেরও ক্ষতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওষুধে কাজ না হলে অপারেশন প্রয়োজন।
ডায়াবেটিস দীর্ঘদিন খুব বেশি মাত্রায় থাকলে শরীরে যে কোনও ক্ষত সারতে অনেক সময় লাগে। ফলে বিভিন্ন ব্যাকটিরিয়া ক্ষতের মধ্যে দিয়ে সহজেই রক্তে প্রবেশ করে। এই ব্যাকটিরিয়া থেকে ইনফেকশন অনেক সময়ই শিরদাঁড়ায় ছড়িয়ে নার্ভের সমস্যা ডেকে আনে। শিরদাঁড়ায় টিউমার হলে, টিউমারের চাপ শিরদাঁড়ার সঙ্গে যুক্ত নার্ভের উপরও পড়ে।
ভাইরাল ফিভার কিংবা কোনও ভ্যাকসিন নিলে তা থেকে জ্বর আসতে পারে। এই এব জ্বর যদি ১-২ সপ্তাহ টানা থাকে তাহলে সাবধান। জ্বরের সঙ্গে প্যারালাইসিস বা হাত-পা অসাড় হলে বুঝতে হবে জ্বরের ভাইরাসের প্রকোপ শিরদাঁড়া থেকে স্নায়ু অবধি গিয়েছে।
বশে আনতে
মাথা উঁচু করে বাঁচতে গেলে মেরুদণ্ড সোজা রাখুন। একটানা বসে, ঘাড় গুঁজে কাজ করার দীর্ঘ অভ্যাস থেকেই ঘাড়ে ও শিরদাঁড়ার সমস্যা শুরু হয়। এসবের ব্যথা অবহেলা না করাই উচিত।
ওষুধ না অপারেশন?
শিরদাঁড়ার সমস্যার কারণ স্পন্ডেলোসিস হলে প্রাথমিক অবস্থায় ফিজিওথেরাপি, এক্সারসাইজ করলে ব্যথা কমে যায়। তবে স্পন্ডিলোসিসের জন্য স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তখন ঘাড়, কোমরে ব্যথার সঙ্গে স্নায়ুজনিত আনুষঙ্গিক সমস্যা দেখা যাবে। খুব বাড়াবাড়ি হলে তখন অপারেশন ছাড়া কোনও গতি নেই।
মাইক্রোসার্জারি করে এই অপারেশন হয়। শিরদাঁড়ার যে হাড়ের মাঝখানের ডিস্কে চাপ পড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। মাইক্রোসার্জারি করে সেই ডিস্ক খুলে ঠিক অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ডিস্ক বেশি ড্যামেজ হলে মেটাল ডিস্ক বসিয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু স্পাইনাল টিউমার, টিবি বা অন্য কোনও ভাইরাস থেকে ইনফেকশনের জন্য শিরদাঁড়া ও নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, শিরদাঁড়া বেঁকে ও ভেঙে গেলে রডস অ্যান্ড স্ক্রু অপারেশন বা বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সাহায্যে বড় অপারেশন করার প্রয়োজন হয়।
অর্থো না নিউরোস্পাইন?
হাঁটু, কোমরে ব্যথা কিছুতেই কমছে না? আচমকা কোনও চোট, বয়সজনিত কারণে ব্যথা হলে অর্থোপেডিক বা হাড়ের ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ভাল। কিন্তু ঘাড়ে, পিঠে, হাতে ও পায়ে প্রায়ই ব্যথা হলে তার উৎস শিরদাঁড়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে স্পাইন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। নিউরো ও অর্থো দুই ক্ষেত্রেই স্পাইন বিশেষজ্ঞ হয়। শিরদাঁড়ার সঙ্গে যেহেতু বিভিন্ন নার্ভ যুক্ত, তাই এখানে কোনও আঘাত যে কোনও সময়ই নিউরোর সমস্যা ডেকে আনতে পারে। সেক্ষেত্রে নিউরো-স্পাইন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন। তবে অনেক সময়ই রোগীর সমস্যা অনুযায়ী নিউরো-স্পাইন ও অর্থো-স্পাইন দুই বিশেষজ্ঞেরই পরামর্শ সমান জরুরি। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো এমআরআই স্ক্যান করে বোঝা সম্ভব, এই ধরনের ব্যথার পিছনে লুকিয়ে শুধু হাড়ের চোট না কি নার্ভের সমস্যাও।
পরামর্শে যোগাযোগ: ০৩৩- ৪০৩০৯৯৯৯
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.