গৌতম ব্রহ্ম: টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধে নাক কাটা গিয়েছিল চার ব্রিটিশ সেনার। সেই কাটা নাক জোড়া লাগিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন এক মাদ্রাজি বৈদ্য। ভারতীয় শল্যচিকিৎসার সেই জাদুকাহিনি ১৭৯৩ সালে মলাটবন্দি করেছিল ‘মাদ্রাস গেজেট’, ১৭৯৪-তে ব্রিটেনের ‘জেন্টেলম্যানস ম্যাগাজিন’। নাকের অস্ত্রোপচার বা রাইনোপ্লাস্টির উল্লেখ রয়েছে সুশ্রুত সংহিতাতেও। প্রায় ২৬০০ বছর আগে মহর্ষি সুশ্রুত মাছের পটকায় জল ভরে ছাত্রদের অস্ত্রোপচার শিখিয়েছেন। অথচ, ভারতীয় বৈদ্যরা এখন শল্যচিকিৎসা জানেন না। আয়ুর্বেদে জেনারেল সার্জারি ব্রাত্য।
শ্যামবাজারের জে বি রায় আয়ুর্বেদ কলেজে অপারেশন থিয়েটারে মাঝেমধ্যে লাল আলো জ্বললেও তাতে ‘জেনারেল সার্জারি’ সেই অর্থে হয় না। অর্শ, ভগন্দর, নালিঘার অস্ত্রোপচার হয়। টিউমারও কাটা হয়। তবে, সেখানে অ্যানেস্থেশিয়ার প্রয়োগ নেই। এই পরিস্থিতিতে ফের আশার আলো জাগিয়ে তুলল ১১ ডিসেম্বর আয়ুশ মন্ত্রকের একটি টুইট। যাতে বলা হয়েছে, আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় শল্যচিকিৎসাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে আয়ুশ মন্ত্রক বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যেই ‘সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন আয়ুর্বেদিক সায়েন্সেস’ (সিসিআরএএস) ও বিভিন্ন রাষ্ট্রয়ত্ত সংস্থা এই ব্যাপারে একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে।
সুশ্রুতের দেখানো পথে যাতে পুরনো গৌরব ফেরানো যায় তার ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছে কেন্দ্রীয় আয়ুশ মন্ত্রক। এই খবরেই উজ্জীবিত আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা। তাঁদের আশা, ফের জে বি রায় কলেজের ওটিতে জেনারেল সার্জারি হবে। আয়ুর্বেদের কেন্দ্রীয় নিয়ামক সংস্থা(সিসিআইএম)-এর এথিকস কমিটির সদস্য তথা রাজাবাজারের শ্যামাদাস বৈদ্যশাস্ত্রপীঠের অধ্যাপক ডা. প্রদে্যাৎবিকাশ কর মহাপাত্র জানান, আয়ুর্বেদই গোটা বিশ্বকে অস্ত্রোপচার শিখিয়েছে। বিশেষ করে প্লাস্টিক সার্জারি। শুশ্রুত ১০১ রকম সার্জারি যন্ত্রের ও ২০ রকম শাস্ত্রের উল্লেখ করেছেন। জে বি রায় আয়ুর্বেদ হাসপাতালে এখনও এমার্জেন্সি লেখা বোর্ড রয়েছে। এখনও ওটিতে লাল আলো জ্বলে। পঞ্চকর্ম, ক্ষারকর্ম, অগ্নিকর্ম হয়। খুশি আয়ুর্বেদ পাঠরত ছাত্ররাও। ন্যাশনাল আয়ুর্বেদ স্টুডেন্টস অ্যান্ড ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত সংযোজক ডা. সুমিত সুর জানিয়েছেন, “বৈদিক যুগ থেকেই সুশ্রুতের অবদান চিকিৎসাশাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেছে। অথচ, আমাদের বাদ দিয়ে শুধু এমবিবিএসদের শল্যচিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এর পরিবর্তন প্রয়োজন।”
আয়ুশ মন্ত্রকের টুইটের নেপথ্যে রয়েছেন এক বাঙালি। ড.নির্মল মাইতি নামে বিধাননগর সরকারি কলেজের ওই পদার্থবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক সম্প্রতি এই নিয়ে টুইট করেন। বলেন, “সার্জারির জন্ম দিয়েছে আয়ুর্বেদ। গোটা বিশ্ব সুশ্রুতকে ‘ফাদার অফ সার্জারি’ বলে মান্যতা দিয়েছে। অ্যালোপ্যাথি এই সার্জারির দৌলতেই এগিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে আয়ুর্বেদেও শল্যচিকিৎসার বহর বাড়ানো উচিত। আয়ুষ্মান ভারতে তা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।” ওঁর টুইট দেখে আয়ুশ মন্ত্রক উজ্জীবিত। কেন আয়ুর্বেদে শল্যচিকিৎসাকে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে জে বি রায় হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. পুলক করের পর্যবেক্ষণ, ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়নের ভয়ে বৈদ্যরা একসময় শল্যচিকিৎসা বন্ধ করেছিলেন। অথচ, বুদ্ধের সমসাময়িক বৈদ্যরাজ জীবক ব্রেন অপারেশন করে কৃমি বের করেছিলেন। সুশ্রুত ছানি অপারেশনও করেছেন। বৈদ্যরা একসময় দাঁতও তুলতেন। জলন্ধরবন্ধ মুদ্রার মাধ্যমে চোয়াল অবশ করে অস্ত্রোপচার হত। সম্প্রতি দিল্লির এইমস-এর সার্জনরা ‘বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি’-র আয়ুর্বেদক অধ্যাপক ডা. মনোরঞ্জন সাউয়ের থেকে ক্ষারসূত্রর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আয়ুর্বেদ মতেই ‘অ্যানোরেকটাল সার্জারি’ হচ্ছে এইমসে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.