অনির্বাণ চৌধুরী: কার্তিক বড় হ্যাংলা!
হ্যাংলা কেন? না, ওই যে ছড়া কেটে বলি আমরা- একবার আসেন মায়ের সঙ্গে, একবার আসেন একলা!
আমার কিন্তু অন্য কথাই মনে হয়। বাকি তিন ছেলে-মেয়েও তো মায়ের সঙ্গে একবার আসেন, আরেকবার আসেন নিজের মতো! সব ছেড়ে তাহলে আর কার্তিককে নিয়ে পড়া কেন?
এই ঠাকুরটি হ্যাংলা অন্য কারণে। আসলে ছোট থেকে তিনি বড়ই ভালবাসার কাঙাল! এক স্ত্রী থাকার পরেও সেই ভালবাসা খুঁজতে যে কারণে ছদ্মবেশ ধরতে হয় তাঁকে। আদায় করে নিতে হয় কাঙ্ক্ষিত রমণীর প্রেম।
দুই স্ত্রী? কার্তিক তাহলে চিরকুমার নন?
আদপেই নন! তবে বিয়ের আগে তাকাতে হবে তাঁর জন্মের দিকে। নইলে রাম না জন্মাতেই রামায়ণের মতো একটা ব্যাপার-স্যাপার তৈরি হয়ে যায়।
পুরাণ, লোককথা, কালিদাসের কাব্য- সব মিলিয়ে জানা যাচ্ছে একদা ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে দেবতাদের স্বর্গছাড়া করেছিল তারকাসুর। ব্রহ্মা তাকে বর দিয়েছিলেন- একমাত্র শিবের ঔরসজাত পুত্র ছাড়া আর কেউ তাঁকে বধ করতে পারবে না।
অসুরের ফন্দি ছিল ভালই! কেন না, শিব তখন সংসারত্যাগী ঘোরতর সন্ন্যাসী। সদ্য মৃত্যু হয়েছে তাঁর প্রথম স্ত্রী সতীর। শোকগ্রস্ত শিব ফলে আর কারও দিকেই তাকাচ্ছেন না। এমন সময়েই হিমালয়ের ঘরে জন্ম নিলেন পার্বতী। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পথ পেরিয়ে তাঁর সঙ্গে বিয়েও হল শিবের। কিন্তু, সন্তান হল না। ক্রমাগত রমণসুখেই লিপ্ত থাকলেন হরগৌরী।
বিপদ দেখে দেবতারা পাঠালেন অগ্নিকে। তিনি শিবকে অনুরোধ করবেন পুত্রের জন্মদানের জন্য। অগ্নি যখন পৌঁছলেন, তখন শিব-পার্বতী কৈলাসের এক গুহায় নিভৃত সুখসন্ধানে রত। অগ্নি আচমকা গুহায় প্রবেশ করায় স্খলিত হল শিবের বীর্য। তিনি তা নিক্ষেপ করলেন অগ্নিতেই। কিন্তু, সেই তেজ ধারণ করে রাখতে পারলেন না অগ্নি। ভাসিয়ে দিলেন গঙ্গার জলে।
অতঃপর, সেই বীর্য ভাসতে ভাসতে গিয়ে ঠেকল এক শরবনে। এবং, জন্ম নিল এক সন্তান। তার ছ’টি মুখ। স্নান করতে এসে ছয় কৃত্তিকা দেখলেন সেই শিশুটিকে। বাড়ি নিয়ে গেলেন তাঁরা। পালন করতে থাকলেন নিজের ছেলের মতোই। কৃত্তিকার পালিত সন্তান বলেই নামও হল কার্তিক। কার্তিকের ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার সেই শুরু। জানতেও পারলেন না তিনি, কারা তাঁর বাবা-মা! আসল বাবা-মার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েই বড় হলেন তিনি। অতুলনীয় হলেন শস্ত্রে এবং শাস্ত্রে।
ঠিক সময়মতো কার্তিককে এবার কাজে লাগালেন দেবতারা। একটু বড় হতেই তাঁকে জানালেন তাঁর বংশপরিচয়। এবং, পাঠালেন তারকাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে। নিয়মমতো তারকাসুর বধও হলেন কার্তিকের হাতে। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ইন্দ্র তাঁর মেয়ে দেবসেনার সঙ্গে বিয়ে দিলেন শিবপুত্রের। এখানেই দ্বিতীয় ধাপে ভালবাসার পথ থেকে সরে এলেন কার্তিক। প্রেম কী, তা বোঝার আগেই শুরু হল তাঁর দাম্পত্য। সেই জন্যই তাঁকে আমরা বলি দেবসেনাপতি! অর্থাৎ দেবসেনার পতি! এর সঙ্গে সৈন্যবাহিনীর অধিপতির মিল খোঁজা খুব একটা যুক্তিযুক্ত নয়। কেন না, যুদ্ধের সময় দেবসৈন্যবাহিনী চালনা করলেও কার্তিক খুব তাড়াতাড়িই সেই পদ থেকে সরে আসবেন স্বেচ্ছায়। অনেকটা অভিমান নিয়ে।
বিয়ের পর স্ত্রী দেবসেনার সঙ্গে কৈলাসেই রয়েছেন কার্তিক। মা, বাবা আর ভাই গণেশের সঙ্গে সুখে দিন কাটছে তাঁর। কিন্তু, সেই সুখের দিনে গ্রহণ এল। একদিন গণেশের সঙ্গে তাঁর শুরু হল প্রতিদ্বন্দ্বিতা- কে আগে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারবে! ময়ূরে চড়ে সারা পৃথিবী ঘুরে এসে কার্তিক দেখলেন, বিজয়ীর সম্মান পেয়েছেন গণেশ। তিনি বাবা-মাকেই পৃথিবীজ্ঞানে তাঁদের প্রদক্ষিণ করে কাজ সেরেছেন। সবাই প্রশংসা করছেন তাঁর বুদ্ধিমত্তার!
অভিমানে তখন কৈলাস ত্যাগ করলেন কার্তিক। স্ত্রী দেবসেনাকে নিয়ে চলে এলেন দক্ষিণ ভারতে। বসতি করলেন পাহাড়ে। উপজাতি তাঁকে বরণ করে নিল সাদরে। ময়ূরবাহন বা মুরুগন বলে জানাল শ্রদ্ধাও! কিন্তু, ভালবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা কার্তিকের মন থেকে দূর হল না। তখনও যদিও তিনি জানতেন না, প্রেম এসে ধরা দিতে চলেছে তাঁর বাহুবন্ধনে। দক্ষিণ ভারতের এই পাহাড়েই সার্থক হবে তাঁর প্রেমের কামনা।
কার্তিক তাই কিছুটা মনমরা হয়েই থাকেন। ঘুরে বেড়ান ইতিউতি। এমন সময়ে একদিন তিনি দেখলেন, এক পাহাড়ি ক্ষেতে শস্য পাহারা দিচ্ছে একটি কালো মেয়ে! যতই কালো হোক, কার্তিক তুমুল ভাবে তার প্রেমে পড়লেন। এক বৃদ্ধের ছদ্মবেশে গিয়ে নাম জানতে চাইলেন, জানতে চাইলেন পরিচয়। শুনলেন, সে সেখানকার উপজাতি রাজার মেয়ে। তার নাম বল্লী।
এবার কার্তিক চাইলেন বল্লীকে বিয়ে করতে। সে কথা বলতেই বল্লী রেগে আগুন হলেন! তিনি সদ্য যুবতী, তাঁর কেন এক বৃদ্ধকে মনে ধরবে! বিপদ দেখে কার্তিক তখন স্মরণ করলেন গণেশকে। গণেশও ভাইয়ের মনের কথা ভেবে এক মত্ত হস্তীর রূপ ধরে আটকে দাঁড়ালেন বল্লীর রাস্তা।
বল্লীর আর উপায় নেই! মত্ত হাতির ভয়ে তিনি জড়িয়ে ধরলেন সেই বৃদ্ধকে। ভয়ে তাঁর দু’ চোখ বোজা! সেই অবস্থাতেও মরিয়া কার্তিকের দয়া হল না। তিনি আদায় করে নিলেন প্রতিশ্রুতি- হাতিটাকে তাড়াতে পারলে বল্লী তাঁকে বিয়ে করবেন! নয় তো দু’জনেই মরবেন! রাজি হতে তাই বাধ্য হলেন বল্লী।
যখন তিনি চোখ খুললেন, দেখলেন সেই বৃদ্ধের জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক সুপুরুষ যুবক। এর পর আর বিয়েতে আপত্তি থাকার কথা নয়। বিয়ে হলও ধুমধাম করে। এবং, বল্লীর সঙ্গে দাম্পত্য আর প্রেম পূর্ণ ভাবে উপভোগ করার জন্য দক্ষিণ ভারতের ছয়টি স্থানে ছয়টি শস্ত্রাগার নির্মাণ করলেন কার্তিক! যেখানে তৃপ্ত হবে তাঁর অস্ত্রচর্চা আর প্রেমচর্চা- দুই! সেই ছয়টি শস্ত্রাগার আজ ভারতের সবচেয়ে পবিত্র কার্তিক মন্দিরে পরিণত হয়েছে।
অনেকে বলতেই পারেন, এ ছিল দক্ষিণ ভারতের কথা। বাংলায় কার্তিক চিরকুমার। তা-ই যদি হবে, তবে সন্তান, বিশেষ করে পুত্রসন্তান উৎপাদনের জন্য কেন কার্তিক ফেলা হবে নবদম্পতির বাড়ির সামনে? যদি কার্তিক সন্তান উৎপাদনের দেবতা না-ই হন, তবে কাটোয়ায় কেন বিখ্যাত হবে সুঠাম গড়নের ল্যাংটো কার্তিকের পুজো? কার্তিক যদি কঠোর ভাবে ব্রহ্মচারীই হন, তবে গণিকামহলে কেন তাঁর এত জনপ্রিয়তা? এই বাংলায় কার্তিক পুজো তো বিশেষ ভাবে প্রচলিত ছিল গণিকামহলেই!
কার্তিকের বিয়ের কথা ভুললেও যুদ্ধের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা কিন্তু বাঙালি ভোলেনি। কাটোয়ার কার্তিক লড়াইয়ের কথা এই প্রসঙ্গে না তোলা খুব অন্যায় হবে। অনেকে বলেন, কাটোয়ার কার্তিক পুজো বিখ্যাত বলেই এক পুজোর সঙ্গে অন্য পুজোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা কার্তিক-লড়াই বলে পরিচিত! আদতে ব্যাপারটা অন্য।
কার্তিক পুজোর দিন কাটোয়ায় এক বড়সড় মিছিল নামে পথে। সব পুজো-মণ্ডপের দলবল তাদের ঠাকুর নিয়ে বেরোয় শোভাযাত্রায়। সঙ্গে চলে লড়াই- কার ঠাকুর আগে যাবে! এই যুদ্ধ রীতিমতো লাঠিসোটা, এমনকী তরোয়াল নিয়েও চলে! এভাবেই যুদ্ধ আর সন্তান উৎপাদন- দুইয়ের অনুষঙ্গেই কার্তিককে স্মরণ করে বাঙালি!
তবে, আত্মবিস্মৃত বলে বাঙালির একটা বদনাম আছে তো! সেই আত্মবিস্মৃতিই কার্তিককে চিরকুমার হিসেবেই রেখে দেয়! হ্যাংলা বলে বদনাম দেয়, অথচ বুঝতে চায় না তাঁর দীর্ঘ দিন ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকার কথা।
কার্তিক মনে মনে হাসেন! তার পর ফিরে যান কোন স্ত্রীর কাছে?
নিজেই ভেবে দেখুন না! অ্যারেঞ্জড্ আর লাভ ম্যারেজের মধ্যে কোনটার আকর্ষণ বেশি হওয়ার কথা!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.