গৌতম ব্রহ্ম: শরীর যদি মন্দির হয়, তবে মন হল সেই মন্দিরের দেবতা। উপাস্যকে তুষ্ট করলে উপাসনালয়ও রক্ষা পাবে বিপর্যয় থেকে। এই তত্ত্বে বিশ্বাস রেখে মন চাঙ্গা করে ফুসফুস (Lungs) সতেজ রাখার চেষ্টা? তা-ও আবার ভেন্টিলেশনে থাকা রোগীদের! যাঁদের কথা বলার উপায় নেই, গলার ভিতরে ঢোকানো রয়েছে এন্ডোট্র্যাকিয়াল টিউব। কোভিডের ছোবলে বিপর্যস্ত ফুসফুসে জবরদস্তি পাঠানো হচ্ছে অক্সিজেন (Oxygen)। শরীরজুড়ে আইটিইউবাসের হরেক চিহ্ন।
পুরোদস্তুর ভেন্টিলেশনে থাকা এমন রোগীই এখন বেডে বসে খাতা-পেন নিয়ে খসখস করে লিখে চলেছেন নিজের সমস্যা। বিছানার চাদর সরাতে গিয়ে কীভাবে কাহিল হয়ে পড়ছেন, কীভাবে কফের আধিক্য দেখা যাচ্ছে, ফুসফুসকে চাঙ্গা করার উপায় কী – কালির আঁচড়ে নিজের শারীরিক অবস্থার চালচিত্র ফুটিয়ে তুলে ডাক্তারবাবুদের কাছে উপদেশ চাইছেন। কখনও প্রকাশ করে ফেলছেন উদ্বেগ, ‘আমার এন্ডোট্র্যাকিয়াল টিউবটা ঠিক আছে তো? কফ জমে আটকে যায়নি তো?’
রোগধ্বস্ত শরীরে আটকে থাকা মানসিক উৎকণ্ঠা এ ভাবে ‘স্টিম আউট’ করার সুফলও মিলছে হাতেনাতে। কী রকম? যেমন অর্ণব বাগচী। টালিগঞ্জের এম আর বাঙুর হাসপাতাল (MR Bangur Hsopital), বেড নম্বর ৭১১। বেশ ক’দিন ধরে ভেন্টিলেশনে, জীবনদায়ী যাবতীয় সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। ডাক্তারবাবুরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সুস্থ করে তোলার। এমন ৭৫ জন কোভিডরোগী রয়েছেন বাঙুরের CCUয়ে, যাঁদের বড় অংশই অর্ণবের মতো ভেন্টিলশনে। কিন্তু ওঁদের চেতনা রয়েছে। এবং মনের জোর বাড়িয়ে ওঁরা যাতে লড়াইটা আরও জোরদার করে তুলতে পারেন, সে জন্য হাতে পেয়েছেন কাগজ-কলম। নিজেরাই লিখে লিখে জানাচ্ছেন সমস্যার কথা, চিকিৎসকের আশ্বাস বাড়িয়ে আত্মবিশ্বাস, যুদ্ধজয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন কয়েক কদম।
বস্তুত ভরসাবৃদ্ধির অভিনব পদ্ধতিটি CCUয়ের চিরাচরিত ভারাক্রান্ত পরিবেশ বিলকুল বদলে দিয়েছে। অর্ণবের মতো অনেকেই নিজের সমস্যা ডাক্তারবাবুদের লিখে জানাচ্ছেন। তাতে চিকিৎসায় যেমন সুবিধা হচ্ছে, করোনা রোগীর মনে থাবা গেড়ে বসা আতঙ্কও কাটছে। অর্ণবের মতো ৭১২ ও ৭১৪ নম্বর বেডের রোগীরাও একই পথের পথিক।
ডাক্তারবাবুরা বলছেন, কোভিড এমনভাবে ফুসফুসে ছোবল দিচ্ছে যে, সাধারণ বেডে রেখে অনেকের চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে না। CCU লাগছে, কাউকে পাঠাতে হচ্ছে ভেন্টিলেশনে। বাঙুরের CCU ইনচার্জ ডা. শুভ পালের কথায়, “ভেন্টিলেশন নিয়ে আমজনতার মধ্যে অযথা আতঙ্ক রয়েছে। ভেন্টিলেশন বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। অন্তত কোভিডের ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে।”
কোভিড চিকিৎসায় অনেক ক্ষেত্রেই বাঙুর পথ দেখিয়েছে। তা সে স্টেরয়েড প্রয়োগ হোক, বা ভোররাতে উঠিয়ে প্রাণায়ামের দাওয়াই। এবার এই রাইটিং-থেরাপিও অন্যদের কাছে মডেল হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। “আমরা বলার চেষ্টা করছি, ভেন্টিলেশনে থেকেও রোগী জেনারেল বেডের রোগীর মতোই আচরণ করতে পারেন। লেখালেখি করতে পারেন। সত্তর শতাংশের বেশি রোগী সুস্থও হয়ে যাচ্ছেন।” – মন্তব্য শুভবাবুর। উদ্বেগের ভার কমিয়ে রোগীদের সুস্থতার পথে এগিয়ে দেওয়ার পন্থাটিকে স্বাগত জানাচ্ছে চিকিৎসকমহল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.