হার্ট অ্যাটাক একবার হলে বারবার হতে পারে। তাই দুর্বল হার্ট নিয়ে বেশি ভারী কাজ করার আগে খুব ভেবে এগোন। কারণ কায়িক শ্রম সুস্থ হার্টের জন্য ভালো, কিন্তু দুর্বলদের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। এ ব্যাপারে সাবধান করছেন অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালের সিনিয়র ইন্টারভেনশন্যাল কার্ডিওলজিস্ট ডা. শঙ্খশুভ্র দাস। শুনলেন জিনিয়া সরকার।
সমগ্র শরীরের ছন্দ স্বাভাবিক থাকে যদি ভালো থাকে হার্টের গতিবিধি। কিন্তু এটা একবার বিগড়ে গেলেই ছন্দপতন। তারপর পুরো শরীরটাই সহজে মুহ্যমান হয়ে যায়। নানা রকম নিয়ন্ত্রণ চলে আসে যাপনে।
এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, হার্টের অসুখ বা তা থেকে সেরে ওঠার পর ভারী কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে তো নানা বাধানিষেধ জারি হয়ই, তার সঙ্গে পরিবর্তন করতে হয় চলাফেরার গতিবিধিও। কারণ শারীরিক পরিশ্রমের প্রভাব হার্টে সবচয়ে বেশি। সেটা সবল হার্টের জন্য ভালো হলেও দুর্বল হার্টের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ লাগে। তাই কতটা ভারী কাজ দুর্বল হার্ট সহ্য করতে পারে সে ব্যাপারে জানা দরকার। কারণ দেখা যায়, হার্টের অসুখ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পরে আবার অবনতি হতে, এমনকী, প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসবের কারণ হার্টের অসুখের পরে সঠিক নিয়মাবলি না মানা।
ভারী কাজে হার্টের কী ক্ষতি?
আসলে একটা জিনিস বুঝতে হবে, যখনই আমরা কিছু শারীরিক শ্রম করি বা এক্সারসাইজ করি তখন শরীরের সমস্ত পেশি অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে যায়। পেশিতে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়। শরীরের অন্য পেশীতে রক্ত সংবহন বেশি হয় বলে তুলনামূলক ভাবে করোনারি ধমনিতে রক্ত সঞ্চালন কমে আসে। হার্টরেট বাড়ে, ব্লাড প্রেশার বাড়ে। হার্টে খুব বেশি চাপ পড়ে যায়। এক্সারসাইজের সময় অনেক সময়ই কোনও উপসর্গ দেখা দেয় না।
দরকার ধীরে ধীরে এই ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটির সঙ্গে হার্টের কার্যকারিতার সঠিক যোগসাজশ। না হলেই বিপদ ঘটে যেতে পারে যে কোনও সময়ে। যা থেকে ইসকেমিয়া হয়, করোনারি ধমনির ভিতরে প্লাক জমে, ব্লাড ক্লট তৈরি হয়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।
হার্টের অসুখের মধ্যে করোনারি আর্টারি ডিজিজ সবচেয়ে কমন সমস্যা। দেখা যায় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত রোগীরা যাঁরা আসেন তাঁদের মধ্যে প্রত্যেকটি রোগীই যে উপযুক্ত চিকিৎসা করান হার্ট অ্যাটাকের তা কিন্তু নয়। কিছু সংখ্যক রোগী হার্ট অ্যাটাক পরবর্তী অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি ও অন্যান্য চিকিৎসা করেন, কেউ কেউ আবার শুধু ওষুধ খেয়েই ভালো থাকার চেষ্টা করেন, পরবর্তী ধাপের কোন চিকিৎসাই করান না। এখানেই সমস্যাটা শুরু হয়। মনে করেন ভালো আছেন, শুরু করে আগের মতোই কাজকর্ম করা। কিন্তু হার্ট তো কমজোরি! এটা বুঝতে হবে। এদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ এভাবে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীরা আর উপযুক্ত চিকিৎসার দ্বারা সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের পরবর্তী কাজ করার ক্ষমতার ফারাক বিস্তর।
খেয়াল রাখুন
১) কাজ করতে গেলে অল্পতেই হাঁপ ধরলে, শ্বাসকষ্ট হলে জোর করে আর কিছুই করা উচিত নয়।
২) ক্লান্তি লাগলে জোর করে এক্সারসাইজ বা কোন শারীরিক শ্রম করা উচিত নয়।
৩) কখনওই খাবার পরে হাঁটা চলবে না।
৪) হার্টের অসুখ থাকলে মদ্যপান করা উচিত নয়।
৫) পেসমেকার বসানোর ক্ষেত্রে উন্নতমানের রেট রেসপনসিভ পেসমেকার বসানো ভাল। তাহলে হার্টে চাপ পড়লেও পেসমেকার প্রয়োজন মতো সামলে দিতে পারবে।
কার্ডিয়াক রিহ্যাব কী বলছে, শুনতে হবে
হার্টের অসুখে আক্রান্ত রোগীরা কতটা শারীরিক শ্রম করতে পারবেন এ ব্যাপারে আমরা ডাক্তাররা রোগীদের একটা গাইডলাইন সময়ই দিয়ে দিই। তবে এই গাইড লাইনের সঙ্গে জরুরি কার্ডিয়াক রিহ্যাবিলিটেশন করানো। অর্থাৎ বর্তমানে অনেক হাসপাতালেই যেখানে অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি হয়, পেসমেকার বসানো হয় সেখানে এই বিশেষ বিভাগ রয়েছে। কার্ডিয়াক রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগে ফিজিওথেরাপিস্ট ও অন্যান্য এক্সপার্টরা থাকেন। তাঁরাই রোগীর কী সমস্যা সেই অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যায়াম বা শারীরিক কাজকর্মের পরামর্শ দেন। যেটা একদমই নির্দিষ্ট রোগীনির্ভর। ফিজিওথেরাপিস্টদের সিদ্ধান্তই এক্ষেত্রে চূড়ান্ত। তাই নিজের মতো কিছু না করে রিহ্যাব সেন্টারের এক্সপার্টদের করে দেওয়া ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটির রুটিন মেনে চলা উচিত।
পেশি দুর্বল হলে বেশি সাবধান
দেখা যায়, খেলার সময় বা জিম করার সময় অনেকেরই হার্ট কোলাপস করে যায়। এটা সাধারণত হার্টে পেশির সমস্যা। যাকে বলা হয় কার্ডিওমায়োপ্যাথি। এই সমস্যা থাকলে তাঁদের কখনওই এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক খেলা যেমন ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল কিংবা জিমের সঙ্গে যুক্ত থাকা উচিত নয়। এদের ক্ষেত্রে সাডেন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি।
কার্ডিয়াক স্ক্রিনিং করুন
যাঁদের একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, স্টেন্ট বসেছে, পেসমেকার রয়েছে, কিংবা অল্পতেই হাঁপিয়ে যান, ক্লান্তি বোধ তাঁরা যদি খুব বেশি ভারী কাজ করেন অথবা ভারী এক্সারসাইজ করেন সেক্ষেত্রে আগে কিছু টেস্ট করে দেখে তারপর এই সব কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া দরকার। এমনকী, সাধারণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও এই টেস্ট দরকার।
কারা কতটা কাজ করতে পারেন?
যাঁদের হার্ট অ্যাটাকের উপযুক্ত ট্রিটমেন্ট হয়নি তাঁদের কিন্তু বেশি এক্সারসাইজও মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। অনেকেই মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হলে, হার্টের দুর্বলতা থাকলে বুঝতেই পারেন না। এমন অবস্থায় প্রচুর এক্সারসাইজ করা কিংবা জিম-এ গিয়ে ওয়েট লিফটিং বা ট্রেডমিল করলে হার্ট হঠাৎ করে কোলাপস করে যেতে পারে। এমন ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়।
এবার বলি যাঁদের হার্ট অ্যাটাক পরবর্তী অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি হয়েছে বা স্টেন্ট বসেছে, তাঁরা কীভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসবেন? অতিরিক্ত এক্সারসাইজ? না। চিকিৎসা ৭-১০ দিন পর থেকেই স্বাভাবিক হাঁটাচলা শুরু করুন। বাড়ির ছোটখাটো কাজ করুন। ধরুন, টেবিলটা গোছানো, একটু খাবার বানানো, ঘরের ছোটখাট কাজ করা ইত্যাদি। তবে খুব জোর করে কিছু করা একেবারেই উচিত নয়।
তারপর ১০-১৫ দিন কিংবা ১ মাস পর থেকে হালকা ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ শুরু করা যায়, হালকা হাঁটাও যেতে পারে সপ্তাহে ৫ দিন ৩০ মিনিট করে। তবে শুরুতে ৫-১০ মিনিট হাঁটুন, তারপর ধীরে ধীরে সময় বাড়ান। সুস্থ হয়ে উঠে প্রথমেই বেশি চাপ নেবেন না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.