কোয়েল মুখোপাধ্যায়: বদলানো সম্ভব নয় পারিবারিক ইতিহাস। তবুও জীবনযাপনে স্ট্রোক ডেকে আনে মারাত্মক বিপদ। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের বিশেষজ্ঞরা বলছেন সাতটি নিয়ামে এড়ানো যায় স্ট্রোক।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকে। আর যদি পরিবার-পরিজন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কারও স্ট্রোক হয়ে থাকে, তাহলে তো এই সম্ভাবনা আরও বেশি তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে কী করবেন? কীভাবে আটকাবেন একে? হ্যাঁ, পরিবারের ইতিহাস তো বদলানো সম্ভব নয়। যেটা সম্ভব, সেটা হল, সেই সব ফ্যাক্টর তথা নিয়ামক সম্পর্কে অবহিত এবং সচেতন থাকা, যা স্ট্রোক ডেকে আনে। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের নিউরোলজির সহকারী অধ্যাপক তথা ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটালের ‘অ্যাকিউট স্ট্রোক সার্ভিস’-এর সহকারী অধিকর্তা, ড. নাতালিয়া রস্ট বিশদে জানাচ্ছেন সেই সব নিয়ামক সম্বন্ধেই। তাঁর কথায়, “যা যা বিপদ ডেকে আনতে পারে, তা সম্বন্ধে যদি আগে থেকে জেনে যান, প্রতিরোধ করতে সুবিধাই হবে। সেই নিয়ম মেনেই স্ট্রোক হওয়া এড়াতে আগাম সতর্কতা অবলম্বন করুন। এতে আপনারই মঙ্গল হবে।” তা, কী কী সেই নিয়ামক?
[ আরও পড়ুন: যোগ-জাদুতে গায়েব কিডনির সমস্যা, নেফ্রোলজিস্টের প্রেসক্রিপশনে প্রাণায়ামও ]
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: হাই ব্লাড প্রেসার থাকলে এখনই সাবধান হন। সঠিক সময়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না আনলে মুশকিল বাড়বে। স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পাবে। আর এটা পুরুষ এবং মহিলা, উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ড. রস্টের মতে, নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করুন। বাড়তে থাকলে, সত্ত্বর চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। লক্ষ্য রাখুন রক্তচাপ যেন থাকে ১৩৫/৮৫। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হওয়া উচিত ১৪০/৯০। কী করে সম্ভব? খাবারে নুনের মাত্রা কম করুন। কোনওভাবেই তা যেন দিনে ১,৫০০ মিলিগ্রামের বেশি না হয় (অর্ধেক চা চামচ)৷ হাই কোলেস্টরল যুক্ত খাবার বর্জন করুন। যেমন বার্গার, চিজ এবং আইসক্রিম। প্রতিদিন অন্তত চার থেকে পাঁচ কাপ জল, ফলমূল এবং শাকসবজি রাখুন। সঙ্গে সপ্তাহে দু’ থেকে তিন দিন মাছ। এছাড়া কম ফ্যাট রয়েছে, দুগ্ধজাত এমন খাদ্যদ্রব্য এবং হোল গ্রেন। নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। দিনে অন্তত ৩০ মিনিট। ধূমপান বর্জন করুন। প্রয়োজনে ওষুধ খান।
ওজন কমান: মনে রাখবেন, আজকের দিনে স্থূলতা, শুধু অসময়ে স্ট্রোক নয়। আরও অনেক রোগ-জ্বালা ডেকে আনে। তাই যদি ওজন বেশি থাকে, অবশ্যই বাড়তি মেদ ঝরিয়ে ফেলুন। অন্তত ১০ পাউন্ড তো বটেই। এতে স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। লক্ষ্য কী– আদর্শ বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই হল ২৫ বা তার কম। কী করে সম্ভব? দিনে কখনওই ১,৫০০ থেকে ২,০০০ ক্যালোরির বেশি খাবার গ্রহণ করবেন
না। শরীর—চর্চার সময় বাড়ান। ব্যায়ামের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুন। গলফ খেলুন, টেনিস খেলুন। শরীরকে যতটা সম্ভব ফিট রাখুন।
বেশি করে শরীর-চর্চা করুন: নিয়মিত শরীর-চর্চা এবং ব্যায়াম করলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কাও অনেকাংশে হ্রাস পায়। লক্ষ্য কী? সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন শরীর-চর্চা করুন। অল্প সময়ের জন্য হলেও। কী করে সম্ভব? শুরুটা অন্তত করুন। আর কিছু না পারলে প্রাতরাশ সেরে বরং প্রতিদিন সকালে আপনার পাড়াতেই চক্কর কাটুন। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে একটা ফিটনেস ক্লাব গড়ে তুলুন। এতে একে অন্যের স্বাস্থ্যের উপর নজরও রাখতে পারবেন। শরীর-চর্চা ততক্ষণ করুন, যতক্ষণ না শ্বাস ফুলে আসে কিন্তু কথা বলতে অসুবিধা না হয়। এই স্টেজে পেঁৗছলেই ধীরে ধীরে রিল্যাক্স করুন। লিফট না নিয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। যদি হাতে টানা ৩০ মিনিটও সময় না থাকে, সময়টাকে ছোট ছোট ব্যবধানে ভাগ করে নিন। দশ—পনেরো মিনিট করে কসরত করুন।
[ আরও পড়ুন: অ্যালার্জি চুলকে অস্থির? সমাধানের পথ বাতলালেন বিশেষজ্ঞরা ]
মদ্যপানে লাগাম টানুন: ধূমপানের মতো অবাধ মদ্যপানও স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে দেয়। ড. রস্ট বলছেন, দিনে অন্তত একটা ড্রিঙ্ক নিলে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু এই হার বেড়ে দুই বা তার বেশি হলেই বিপদ বাড়তে থাকবে। লক্ষ্য কী? হয় নিয়ন্ত্রণ করুন, নচেৎ একেবারে বন্ধ করে দিন। কী করে সম্ভব? কোনওভাবেই দিনে একটা ড্রিঙ্কের বেশি নেবেন না। সুরা নানা ধরনের রয়েছে। চেষ্টা করবেন রেড ওয়াইন নিতে। কারণ এতে রেসভিরেট্রল নামে একটি উপাদান রয়েছে, যা হৃদয় এবং মস্তিষ্ককে রক্ষা করে। কতটা করে পানীয় নিচ্ছেন, তার দিকে খেয়াল রাখুন। স্ট্যান্ডার্ড সাইড হল এক গ্লাস ওয়াইনের ক্ষেত্রে ৫ আউন্স। বিয়ারের ক্ষেত্রে ১২ আউন্স।
আর্টারিয়াল ফাইব্রিলেশন: হার্টবিট যদি অনিয়মিত গতিতে হয়, হৃৎপিণ্ডে ক্লট তৈরি হতে পারে। এই ক্লট মস্তিষ্কে পৌঁছে গেলে, স্ট্রোক ডেকে আনতে সক্ষম। কাজেই এ ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া অত্যন্ত জরুরি। লক্ষ্য কী? আর্টারিয়াল ফাইব্রিলেশন থাকলে চিকিৎসা করান। কী করে সম্ভব? অল্পেতেই বুক ধড়ফড় করলে বা শ্বাসকষ্ট হলে চিকিৎসকের কাছে যান। অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট ওষুধ সেবন করতে হতে পারে, যেমন ওয়ারফারিন (কৌমাডিন)। যা—ই নেবেন, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে।
ডায়াবিটিস কন্ট্রোল করুন: ডায়াবিটিস থাকলে অবিলম্বে সতর্ক হন। লক্ষ্য কী? ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখুনকী করে সম্ভব? নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্লাড সুগার চেক করান। ডায়েটের দিকে খেয়াল রাখুন। ওষুধ খান।
[ আরও পড়ুন: কসরৎ নয়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মেদ ঝরানোর উপায় হাতের নাগালেই ]
ধূমপান বন্ধ করুন: এক নয়। একাধিকভাবে ধূমপান শরীরের ক্ষতি করে। এতে রক্ত গাঢ় হয়ে যায়, যার ফলে ধমনীতে প্লাক বিল্ড—আপ বেড়ে যায়, যা শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। লক্ষ্য কী? ধূমপান বর্জন করুন। কী করে সম্ভব? চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নিকোটিন পিল বা প্যাচ নিতে পারেন। কাউন্সেলিং করান। প্রয়োজনে ওষুধ খান।
মনে রাখবেন: স্ট্রোকের লক্ষণ হল ১. শরীরের এক অংশ হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়া, ২. মুখ অসাড় হয়ে যাওয়া, ৩. অস্বাভাবিক এবং প্রচণ্ড মাথাব্যথা হওয়া, ৪. দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসা, ৫. দেহের অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ অসাড় হয়ে আসা, কথা জড়িয়ে আসা ৬. হাঁটার প্রকৃতি বদলে যাওয়া প্রভৃতি। লক্ষণ চিনে রাখলে, সুবিধা আপনারই। তবে চিকিৎসা শুরু করতে যেন দেরি না হয়!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.