গোড়ালিতে শরীরের চাপ সবচেয়ে বেশি পড়ে। সেটা সামাল দিতে চাই সঠিক জুতো ও হিল সাপোর্ট। বুঝে জুতো না পরলে গোড়ালির নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। জানালেন অর্থোপেডিক সার্জন ডা. সুজয় কুণ্ডু। তাঁর কথা শুনে লিপিবদ্ধ করলেন মৌমিতা চক্রবর্তী।
পা মচকে পড়ে গিয়ে গোড়ালিতে ব্যথা পাননি এমন লোকের সংখ্যা চারপাশে কমই আছে। ছোটরা কিংবা মধ্যবয়স্ক থেকে বয়স্করা জীবনে কোনও না কোন সময়ে এ ব্যথা পেয়েছেনই। কারও আবার স্বভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় বারবার পড়ে যাওয়ার সমস্যা। তবে এই মূলে যে জিনিসটি সেটা আরও আবহেলিত। তা হল, ‘জুতো’। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জুতো জোড়ার সমস্যা থেকেই এমন হয়। কিন্তু সে ব্যাপারে সচেতন অনেকই নয়। ভুল জুতোর ব্যবহার পায়ের অধিকাংশ সমস্যার ক্ষেত্রে দায়ী। কিন্তু এটা বোঝেন খুব কম জনেই। শুধু হাঁটা চলা করতেই অসুবিধা হবে তা নয়, হাড়জনিত সমস্যাও বাড়ে।
হিল সাপোর্ট জুতোই পায়ের সাপোর্ট:
ব্র্যান্ডেড কোম্পানির জুতোর দাম যেমন আকাশছোঁয়া তেমনই সেই জুতোর অনেকগুলি ফ্যাক্টর রয়েছে। সেগুলি তৈরিই করা হয় পায়ের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে। অন্যদিকে, বেনামী কোম্পানির জুতোর সুবিধা ও ডিজাইন অনুযায়ী দাম কম ধরা থাকে। তবে কি, দামী জুতো ব্যবহার করলেই পা ভাল থাকবে, এমনটা সবসময় নয়। গোড়ালিকে সুস্থ রাখতে ও ব্যথা হলে তার উপশমের জন্য সর্বদা নরম এক ইঞ্চি সমান মাপের হিল সাপোর্ট দেওয়া জুতোর ব্যবহার করতে হবে। জুতোটি অবশ্যই নরম হতে হবে, কেনার সময় তা হাতে নিয়ে দেখতে হবে।বর্তমানে প্রায় সমস্ত জুতোর দোকানে গোড়ালির জন্য উপযোগী জুতো চাইলে পাওয়া যায়।
দাম ও কোম্পানি ভিন্ন হলেও মানুষের পায়ের পাতার ফুট আর্চ অনুযায়ী জুতো ব্যবহার করা উচিত। কী এই ফুট আর্চ?
পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে আর্চকে বলে মিডিয়াল আর্চ আর কড়ে আঙুলের দিকে আর্চকে বলে ল্যাটারাল আর্চ। মিডিয়াল আর্চের মাঝ বরাবর একটা গর্ত যাদের পায়ে থাকে না, অর্থাৎ পায়ের পাতা যাদের সমান হয় তাদের বলে পেস প্লেনাস (Pes Planus)। গভীরতা বা গর্ত অল্প থাকলে নরমাল ফুট (Normal foot) এবং বেশি গর্ত থাকলে হাই আর্চ বা পেস কেভাস (Pes Cavus or High Arch) বলা হয়।
নর্মাল ফুটের আর্চকে ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য যে জুতো ব্যবহার করা উচিত সেটি পায়ের গোড়ালির বায়ো মেকানিক্স মেনে তৈরি করা আবশ্যক। সমস্ত নামী-দামি থেকে বেনামী জুতোর কোম্পানির সেই বিষয়গুলিতে ওয়াকিবহাল হয়ে জুতো তৈরি করা জরুরি।
নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী আমাদের শরীর পায়ের পাতায় যতটা চাপ দেয় ঠিক ততটাই চাপ মাটি পায়ের পাতার মাধ্যমে আমাদের শরীরকে ফেরত দেয়। সেই চাপ পায়ের গোড়ালির ক্যালকেনিয়াসে (গোড়ালির পেছনের সবচেয়ে বড় শক্তিশালী হাড় এটি যা পায়ের পেছনের অংশ গঠন করে ও শরীরের ওজনকে মাটিতে প্রেরণ করে) এসে পড়ে। এই চাপ পায়ের গোড়ালি বা পায়ের পাতার মাঝখানে পড়তে পারে। একেবারে ফ্ল্যাট, হিল ছাড়া ও শক্ত জুতো পরলে ভবিষ্যতে গোড়ালির ব্যথায় কষ্ট পাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
যাদের গোড়ালিতে ক্যালকেনিয়াল স্পার অর্থাৎ গোড়ালির হাড় বেড়ে থাকে তাদের জুতো শক্ত ও সমান হলে বিপরীতমুখী চাপ গোড়ালিতে পড়ে। দীর্ঘদিন সেই চাপ পড়লে সেই বেড়ে যাওয়া হাড়টি ক্রমাগত ধাক্কা খেয়ে চামড়ার প্রদাহ সৃষ্টি করে প্লান্টার ফ্যাসাইটিস রোগ হতে পারে এবং গোড়ালি মাটিতে ফেললেই যন্ত্রণা হয়। এর সঙ্গে যাদের পায়ের পেস প্ল্যানাস থাকে তাদের পায়ের পাতার আর্চ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা শক্ত জুতো পড়লে গোড়ালির যন্ত্রণা হয়। সে ক্ষেত্রে তাদের জুতোয় একটি নরম মিডিয়াল আর্চ কুশন চিকিৎসকদের পরামর্শে লাগিয়ে নিতে হয় যাতে গোড়ালির সাপোর্ট ও মিডিয়ার আর্চ সাপোর্ট বজায় থাকে।
উপশম ও চিকিৎসা:
পায়ের পাতার বায়োমেকানিক্সের উপযোগী জুতো না পরলে পায়ের গোড়ালিতে সমূহ ব্যথা সৃষ্টি হয়। বসে থেকে প্রথম পা ফেলতে গেলে, ঘুম থেকে উঠে প্রথম হাঁটতে গেলে যন্ত্রণা হয়। প্রাথমিকভাবে বরফ জল বা ঠান্ডা সেঁক দিতে হয়। যদি হালকা একটা ব্যথার রেশ সর্বক্ষণ থাকে সেক্ষেত্রে গরম সেঁক দেওয়া যায়।
গোড়ালিকে ব্যায়ামের মাধ্যমে নাড়াচাড়া করাতে হবে যাতে সেখানকার রক্ত চলাচল ব্যাহত না হয়। এই পদ্ধতিতে দু-তিন মাস ঘরোয়াভাবে চিকিৎসা করলে ব্যথা কমে যায়, কোনও প্রকার ওষুধের প্রয়োজনহয় না। ব্যথা একটু বেশি হলে প্যারাসিটামল ৬৫০ একটি করে তিনবার খাওয়া যেতে পারে।
পরবর্তী ক্ষেত্রে চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহৃত হয়। সাধারণত দু’ভাবে স্টেরয়েড প্রয়োগ করা হয়। ইনজেকশন ও ওরাল ট্যাবলেটের মাধ্যমে দেওয়া হয়। ডায়বেটিস রোগীদের স্টেরয়েড চিকিৎসা করা যায় না। সেক্ষেত্রে তাদের প্লেটলেট থেরাপি ইনজেকশন দ্বারা প্লেটলেট রিচ প্লাজমা (PRP) দিতে হয়। উপরিউক্ত দু’ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিতে অ্যানাস্থেশিয়া করে নেওয়া হয় যাতে ব্যথা কম অনুভূত হয়। এই পদ্ধতি দুটি সারা পৃথিবীতে গ্রহণীয় ও সুরক্ষিত এবং খুব বেশি খরচসাপেক্ষ নয়।
তবে চিকিৎসা যা-ই থাকুক, প্রতিরোধের জন্য সঠিক জুতোর ব্যবহার আবশ্যক। ঘরে বাইরে নরম জুতোর ব্যবহার, সঙ্গে উপযুক্ত হিল সাপোর্ট যুক্ত জুতো পরার অভ্যাস জরুরি। আর সারাদিনের পর রোজ নিয়ম করে গরম জলে পা ডোবাতে হবে। তবেই গোড়ালির স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে। আচমকা পা মুচকে যাওয়াও অনেকটাই কমবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.