ছবি: প্রতীকী।
ধৈর্য ধরুন, দুঃসময় কেটে যাবে। ক্লান্তিকর-একাকী জীবনে মুঠোভরা আনন্দ খুঁজে দিলেন আর জি কর হাসপাতালের বিশিষ্ট মনোবিদ ডা. রাজর্ষি নিয়োগী। লিখছেন পৌষালী দে কুণ্ডু।
জীবন বড় বেরঙিন হয়ে গিয়েছে? বাঁচার ইচ্ছে কমছে? বড্ড একা লাগছে? সমস্যার সমাধান নাকি আর কিছু নেই! এরকম ভাবছেন যে মৃত্যুই সব সমস্যা, দুশ্চিন্তা, যন্ত্রণা, একাকীত্ব থেকে মুক্তি দেবে? অতএব, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। কেউ পরিকল্পনা করেন ধীরে ধীরে, কারও সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে কয়েক সেকেন্ড। তারপরই দ্য এন্ড। কখনও উদ্ধার হয় সুইসাইড নোট। অনেক সময় তা-ও মেলে না। কেউ কেউ অবশ্য চরম মুহূর্তে সফল হন না। কিন্তু এই যে দ্বিতীয়বার বাঁচার সুযোগ মেলে, তা-ও কি ক্ষণস্থায়ী হয় না? সমীক্ষা বলছে, যে ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টায় অসফল হয়েছেন, তিনি আগামী তিন মাসের মধ্যে ফের সুইসাইডের চেষ্টা করেন। তাই এই সময়ের মধ্যেই শুরু করতে হবে আত্মহননের চিন্তা মাথা থেকে মুছে ফেলার প্রয়াস। এই প্রয়াসে শামিল হতে হবে বাবা, মা, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, বন্ধু ও নিকটাত্মীয়দের।
গিভ মি সাম সানশাইন
–যদি কারও আত্মহত্যা করার চিন্তা মাথায় ঘোরে, তাহলে তা নিজের মনে গুমরে না রেখে কাউকে বলুন। অনেক সময় নিকটাত্মীয়র সঙ্গে শেয়ার করতে ইচ্ছা না করলে বন্ধুস্থানীয় কারও কাছেও বলতে পারেন। এতে কিন্তু মানসিক হতাশা কিছুটা হলেও কমে। একইসঙ্গে যিনি শুনলেন তিনিও তৎপর হয়ে বাড়ির বাকি লোকেদের সতর্ক করতে পারেন।
–কারও মনের এই অবস্থা যখন টের পাবেন তখন তাঁকে বলুন, “কেমন আছ?” অনেকের ধারণা, আত্মহত্যার কথা সেই ব্যক্তিকে বারবার জিজ্ঞাসা করলে হয়তো তাঁর মনে সেটাই সারাক্ষণ ঘুরপাক খাবে। তাই এ নিয়ে কথাবার্তা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান। এ ধারণা ভুল। বরং তার সঙ্গে কথা বলে বোঝান যে আপনি তার কষ্ট, সমস্যাটা বুঝতে পারছেন। তার প্রতি সহানুভূতি দেখাবেন না। তার সমস্যা শুধু বোঝার চেষ্টা করুন। তাকে গুরুত্ব দিন। এতে সুইসাইডের প্রবণতা কমে।
একবার চেষ্টার পরে নজরদারি বৃদ্ধি
— আত্মহত্যার চেষ্টা করার পরে বা যে ব্যক্তির মধ্যে হাই সুইসাইডিয়াল রিস্ক আছে, তার উপরে কড়া নজর রাখতে হবে পরিবারের সদস্যদের। একইসঙ্গে দ্রুত মনোবিদের কাছে নিয়ে গিয়ে কাউন্সেলিং করাতে হবে।
–বাড়ির দু’জন লোক সব সময় ওই ব্যক্তির সঙ্গে এক ঘরে থাকুন। এমন প্রিয়জনরা থাকুন যাঁর সঙ্গে সে তার চিন্তাভাবনা শেয়ার করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে। বাড়ির সব দরজা, বাথরুমের লক-ছিটকিনি খুলে রাখা। যাতে ভিতর থেকে নিজেকে বন্দি করে রাখতে না পারে।
—ওই ব্যক্তির হাতের কাছে ধারালো বস্তু, দড়ি বা আঘাত লাগলে ক্ষতি হতে পারে এমন কিছু রাখবেন না। ছাদ বা এমন কোনও জায়গা থেকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সেদিকে যেতে দেবেন না।
—ব্যক্তিকে চুপচাপ বসিয়ে না রেখে যে কোনও কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে। খেয়াল রাখুন, তার মন যেন কখনওই একলা হয়ে গিয়ে আত্মহত্যার কথা ভাবার অবকাশ না পায়।
—কাউন্সেলিংয়ের সময় ডাক্তার ও বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের বলতে হবে, ‘সব শেষ হয়ে যায়নি। এই দুঃসময়টা কেটে যাবে। আবার ভাল সময় আসবে। তার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।’ সাধারণত এই সময় আত্মহত্যা চেষ্টাকারীদের মনে হয়, ‘আমার জীবন এত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে যে, আমি আর কোনওভাবেই বাঁচতে চাইছি না।’ এই প্রসঙ্গে তাকে বোঝাতে হবে, ‘এই মুহূর্তটা টেম্পোরারি। সময়টা ঠিক কেটে যাবে। সবাই পাশে আছে। তার জন্য এমন চরম সিদ্ধান্ত যেন না নেয়।’ বলুন যে, ‘সুইসাইডের চিন্তা যে কারও মাথায় আসে। এটা মোটেই লজ্জাজনক নয়। তাই এসব ভেবে কুঁকড়ে যাওয়ার কিছু নেই। বরং নতুন উদ্যমে জীবনযাপন করুন।’
খুব যখন অস্থির হয়ে পড়বে তখন ডাক্তারের পরামর্শমতো ব্যক্তিকে কিছু ওষুধ খাইয়ে দিতে হবে। এতে উদ্দীপ্ত স্নায়ু শিথিল হয়ে আসে।
কতদিন ঘেরাটোপে
—ব্যক্তি কী কারণে সুইসাইডের চেষ্টা করছেন বা কথা ভাবছেন, তার সমস্যার গভীরতা কত? সেই সমস্যা বা স্ট্রেস বাস্তবে সত্যি কত তাড়াতাড়ি মোকাবিলা করা সম্ভব ইত্যাদি কতকগুলি কারণের উপর নির্ভর করে ব্যক্তির আত্মহত্যা করার প্রবণতা কতদিন থাকবে। সঠিক কাউন্সেলিং ও প্রয়োজনীয় ওষুধের মাধ্যমে ভাল চিকিৎসা হলে সাধারণত তিন থেকে ছ’সপ্তাহের মধে্য ব্যক্তির স্ট্রেস লেভেল অনেকটা কমিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু একবার সুইসাইডের চেষ্টা করলে আগামী তিন মাসের মধ্যে ফের তা করার সম্ভাবনা প্রায় ৬০-৭০%। তাই এই তিন মাস ওই ব্যক্তিকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে হবে।
প্রবণতা কাদের বেশি
ন্যাশনাল মেন্টাল সার্ভে নামে জাতীয় একটি সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ভারতে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরলে সবচেয়ে বেশি সুইসাইডের ঘটনা ঘটে। টিনএজার ছেলেমেয়ে থেকে ৩০ বছর বয়সি এবং ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ়দের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। এছাড়া হঠাৎ আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে, সংসার ভেঙে গেলে, একাকী থাকলে, হঠাৎ সংসারে গুরুত্ব কমে গেলে, বেশি আবেগপ্রবণ হলে, মদ-ড্রাগসের মারাত্মক নেশা থাকলে সুইসাইড করার ঘটনা ঘটে।
আত্মহত্যার প্রবণতা কি রোগ?
এতদিন বলা হত, আত্মহত্যা একটা লক্ষণ। কোনও অসুখ নয়। কিন্তু এখন এই ধারনায় বদল এসেছে। আমেরিকার ডেভিড শিহান নানা উদাহরণ তুলে ধরে আত্মহত্যাকে অসুখ বলেই দাবি করছেন। তাঁর এই দাবিকে মান্যতা দিয়েছেন বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্টরাও। তাঁদের মতে, আত্মহত্যা বা তার চেষ্টা বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, একে শুধু ডিপ্রেশনের একটি লক্ষণ বলা ভুল। আবার আত্মহত্যার ইচ্ছার প্রথম ধাপের লক্ষণ হল, যেখানে রোগী ভাবেন, আমি নিজে সক্রিয় হয়ে কিছু করব না, মৃত্যু চলে এলে ভাল হয়। দ্বিতীয় ধাপে রোগী ঠিক করে নেন তিনি কীভাবে মরতে চান। কিংবা কীভাবে মরলে ভাল হয় এবং সেটা নিয়ে রিসার্চ করা, প্ল্যান করা। তারপর অ্যাকশন ও চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া। এই ধরনের আত্মহত্যায় রোগী বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সব পরিকল্পনা করে রাখেন। কোন জায়গায় কখন সুইসাইড করবেন, সব ঠিক করা থাকে। এমনকী সেই স্থানে ওই সময় গিয়ে একাধিকবার দেখেও আসেন। আর এক ধরনের হয়, যেখানে হঠাৎ কোনও আবেগ থেকে আচমকা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। একে ইম্পালসিভ সুইসাইড বলে। এই সব ধরনের লক্ষণগুলিকে এখন ডিসঅর্ডার বলে ধরা হয়।
কেন মেট্রোয় বেশি ঝাঁপ
মেট্রোয় ঝাঁপ, রেললাইনে দেহ, সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত দেহ, বিষ খেয়ে আত্মঘাতী, বহুতল থেকে লাফ – খবরের কাগজ, খবরের চ্যানেলে এমন খবরগুলি বিস্তারিতভাবে বিবরণ দিয়ে প্রকাশ করলে আত্মহত্যার কথা ভাবছেন যে সব মানুষ, তাঁরা প্রেরণা পান। প্রতিদিনই বহু মানুষ নানা কারণে অবসাদে ভুগছেন। এঁদের অনেকের মাথাতেই সুইসাইডের কথা ঘুরছে। তাই মেট্রোয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার কোনও ঘটনা ঘটলে এবং তা কাগজে বিশদে দেখলে তারা সেই পথ অনুকরণ করে। ভেবে নেয়, ওই ব্যক্তি দিব্যি সফল হয়েছে, তাহলে সে নিজেও হবে। একে মডেলিং বলে। এই মেথডের জন্যই যে সপ্তাহে মেট্রোয় ঝাঁপের ঘটনা ঘটে সেই সপ্তাহে আরও একাধিক এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই মিডিয়াকে এক্ষেত্রে খুব সতর্ক ভূমিকা পালন করতে হবে। বেশ কিছু স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশে শিশু ও টিনএজারদের আত্মহত্যার খবর রিপোর্ট করা নিষিদ্ধ। কারণ এই বয়সীদের মধ্যে অনুকরণের প্রবণতা বেশি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.