ওষুধই প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু যত রোগ তত ওষুধ! বেশিমাত্রায় ওষুধ প্রাণঘাতী।
উপসর্গ হলেই যখন তখন মুঠো মুঠো ওষুধ খাওয়া বন্ধ করুন। ডাক্তারকে দেখিয়ে পরামর্শ মতো ওষুধ খান। বলছেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের ক্লিনিক্যাল ফার্মোকলজির সহ অধ্যাপক ডা. শবনম আরা বেগম। শুনলেন ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য
ধরা যাক, একই সঙ্গে অনেক রোগের চিকিৎসা চলছে। দিনে কম করে ১০-১৫টি ওষুধ খেতে হয়। এমন রোগী কিন্তু যথেষ্ট। ঘটনা হল শুরুতে সমস্যা থাকে দু’-তিনটি। সেই সমস্যা নিরসন করতে গিয়ে ওষুধ খেতে হয়েছে। কিন্তু সেইসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে আরও কিছু ওষুধ খেতে হয়। এইভাবে বাড়তে থাকে ওষুধের সংখ্যা। আমরা যাঁরা চিকিৎসক তাঁরা এটিকে বলি, ‘প্রেসক্রাইবিং কাসকেড’ (prescribing cascade)। একটা সময় আসে রোগী ওষুধে জর্জরিত হয়ে হাসপাতালে আসেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে রোগীকে অনেক সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ খেতে হয়। যার মধ্যে সবই যে প্রয়োজনের এমনটা নয়। এই ওষুধগুলি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বাড়ায়। এই ওষুধগুলির ব্যবহার বন্ধ করলেও চিকিৎসার গুণগত মানের কোনও পরিবর্তন হয় না। বরং নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব অবস্থা ফিরে অাসে রোগীর জীবনে। আর ক্ষতিকারক ওষুধ তো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। একমাত্র ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজিস্ট রোগীর নিরাপত্তার স্বার্থে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বাদ দিতে পারেন। যাকে বলে ডি-প্রেসক্রাইবিং (deprescribing)। যুক্তিগ্রাহ্য ডি-প্রেসক্রাইবিং—এর মাধ্যমে সারাদিনের প্রয়োজনীয় ওষুধ ৫-৭টির মধ্যে কমিয়ে আনা সম্ভব।
ওষুধের বিপদ
একটা কথা না বললেই নয়, কোনও ওষুধই একশো ভাগ নিরাপদ নয়। সব ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। চিকিৎসকের দায়িত্ব, রোগীর শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে এমন ওষুধ দেওয়া যাতে যত কম সম্ভব বিরূপ প্রভাব ফেলে। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, ওষুধ খাওয়ার পরে রোগীর সমস্যা কমলেও ফের অন্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই চিকিৎসককে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ গোষ্ঠীর রোগীদের ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্ভাবনা বেশি ও বিভিন্ন হতে পারে। যেমন, প্রবীণ ও শিশুদের ক্ষেত্রে বাড়তি সাবধানতা নেওয়া দরকার। একই রকম ভাবে গর্ভবতী ও প্রসূতিদের নির্দিষ্ট ও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ওষুধ ব্যবহার না করাই ভাল। আবার লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিসের মতো রোগীদের প্রেসক্রিপশন করার আগে অতিরিক্ত সতর্কতা নিতে হয়।
নিজের চিকিৎসা পরিহার করুন
অহেতুক অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নেওয়া অনেকের অভ্যাস হয়ে গেছে। চিকিৎসক না হয়েও ওষুধের দোকানে গিয়ে মুড়ি-মুড়কির মতো ওষুধ কিনে খান। অনেকে আবার ইন্টারনেট দেখে উপসর্গ দেখেই ওষুধ খেতে শুরু করেন। এমনটা কিন্তু নিছক বোকামো বলেই মনে হয়। সামান্য মাথাধরা বা পেটখারাপের ওষুধও ডাক্তার না দেখিয়ে খেলে জীবন সংশয় হতে পারে এমন উদাহরণও যথেষ্ট।
নিয়ম মেনে ওষুধ খান
চিকিৎসকের নির্দেশ মেনে ঠিক সময়মতো ওষুধ খেতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রোগীরা এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন না। যেমন প্রেশার, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস বা হার্ট ফেলিওর-এর ক্ষেত্রে। ঠিক সময়ে ওষুধ না খেলে যেমন চিকিৎসা ব্যাহত হয়, তেমনই আচমকা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর ব্যতিক্রম হলে সমস্যা প্রাণঘাতী হতে পারে। রোগীকে হাসপাতালেও নিয়ে যেতে হয়। আবার ওষুধ খেতে ভুলে যাওয়া আরেক সমস্যা। বিশেষ করে বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রেই এই সমস্যা দেখা যায়। তাই মনে রাখার জন্যও প্রযুক্তিনির্ভর হওয়া ভাল।
ফার্মাকোলজির গুরুত্ব
ওষুধ ও রোগনির্ণয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি বিশেষ বিষয়ের অন্তর্গত। যার নাম ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজি। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজি আউটডোর চালু রয়েছে। ওষুধ সংক্রান্ত যে কোনও সমস্যায় সঠিক পরামর্শের জন্য সেখানে সরাসরি যেতে পারেন রোগীরা। এমনকী, অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও তাঁদের ওষুধ বিষয়ক যাবতীয় জিজ্ঞাসা ও সন্দেহ নিরসনের জন্য ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজিস্ট—এর পরামর্শ নিয়ে থাকেন। ওষুধ ব্যবহারের আপাতজটিল বিষয়টিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। সম্প্রতি ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজি বিশেষজ্ঞ পরামর্শের অনলাইনে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আমাদের দেশে ২০১০ সাল থেকে ওষুধ নিরাপত্তা কর্মসূচি বা ফার্মাকোভিজিল্যান্স প্রোগ্রাম অফ ইন্ডিয়া চলছে। কোনও চিকিৎসক কোনও ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার খোঁজ পেলেই, তা জানিয়ে দিতে পারেন। প্রয়োজনে রোগী ও তার পরিবারও যোগাযোগ করে অভিযোগ জানাতে পারেন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.