২৫ ঊর্ধ্বদেরও ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলছে আকছার। কেন ঘটছে এরকম ঘটনা? কীভাবে প্রতিহত করবেন স্ট্রোকের প্রকোপ? লক্ষণ চিনিয়ে সাবধান করলেন এইচ পি ঘোষ হাসপাতালের কনসালট্যান্ট নিউরোলজিস্ট ডা. অম্লান দত্ত। পারমিতা পাল।
জীবনের ইঁদুর-দৌড় যত বাড়ছে ততই বাড়ছে রোগভোগ। রীতিমতো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তিরিশ পেরনো যুবক-যুবতীরা। কয়েক দশক আগেও পঞ্চাশোর্ধ্ব বা ষাটোর্ধ্বদের মধ্যে ব্রেন স্ট্রোকের প্রবণতা দেখা যেত। কিন্তু শেষ ১০-১৫ বছরে ছবিটা বদলেছে। ২৫ ঊর্ধ্বদেরও ব্রেন স্ট্রোক আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলছে আকছার। প্রাণ তো কাড়ছেই, নয়তো সারা জীবনের মতো শয্যাশায়ী করে দিচ্ছে এই স্ট্রোক।
কী হয়?
স্ট্রোক সাধারণত দুধরনের- ইস্কেমিক স্ট্রোক (ধমনির ভিতরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে, মস্তিষ্কে রক্ত যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, ফলে সেই অংশটি মরে যায়), হ্যামারেজ স্ট্রোক (ধমনি ছিঁড়ে গিয়ে শরীরের ভিতরেই রক্তক্ষরণ হওয়া)। কোন ধরনের স্ট্রোক হয়েছে, তা বুঝতে প্রথমেই সিটি স্ক্যান করা দরকার। এই রিপোর্টের উপর নির্ভর করেই হয় চিকিৎসা। কারণ, দুটি স্ট্রোকের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা।
কেন অল্পবয়সিদের স্ট্রোক বাড়ছে?
কোনও একটা কারণ নয়, একাধিক কারণের যোগফল অল্পবয়সিদের স্ট্রোক।
- আধুনিকতার অভিশাপ! আজকের জীবন অনেক বেশি মেশিন নির্ভর। কমেছে শারীরিক কসরত। হাঁটাহাঁটি একেবারে হয় না বললেই চলে। এই ছবিটা শুধুমাত্র শহরের নয়, গ্রামের দিকেও একই ছবি দেখা যাচ্ছে।
- স্বাস্থ্যকর খাবারের বদলে অনেক বেশি ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড নির্ভর হয়ে পড়ছে নয়া প্রজন্ম। সঠিক সময়ে খাওয়াদাওয়া হয় না।
- কমেছে ঘুমের সময়। সুস্থ থাকতে ৮ ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক। কিন্তু জীবনযাত্রা বা কাজের চাপে পর্যাপ্ত সময় ঘুম হয় না। যার অবশ্যম্ভাবী ফল হতে পারে স্ট্রোক। হৃদরোগ বা মানসিক অসুস্থতার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
- বাড়তে থাকা মানসিক চাপ।
- অনিয়ন্ত্রিত ধূমপান, মদ্যপান।
- জিনগত কারণেও কমবয়সিদের মধ্যে হতে পারে স্ট্রোক।
- রক্তবাহের ভিতরের দেওয়ালে কোলেস্টরল বা চর্বি জমে ধমনি সরু করে দেয়। যাকে মেডিক্যাল পরিভাষায় বলা হয়, অ্যাক্রোস্কেলোরসিস। ইউরোপ, আমেরিকার বাসিন্দাদের মধ্যে এই প্রবণতা সাধারণত ৩৫-এর পর দেখা যায়। কিন্তু ভারত তথা দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে ২৫-এর পরেই এই প্রবণতা তৈরি হয়ে যায়। যা অত্যন্ত অল্পবয়সেই স্ট্রোক ডেকে আনে।
লক্ষণ
সাধারণত কোনও ওয়ার্নিং দিয়ে স্ট্রোক আসে না। তবে কেউ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছে কি না তা বোঝার কয়েকটি লক্ষণ রয়েছে।
- B-ব্যালান্স। দেহ ভারসাম্যে সমস্যা। হাঁটতে গিয়ে টলে পড়ে যাওয়া। শরীর একদিকে বেঁকে যাওয়া।
- E- আই বা চোখ। হঠাৎ করে চোখে অন্ধকারের পর্দা নেমে আসে। একটা জিনিসকে দুটো দেখা।
- F- ফেস বা মুখ। মুখ একদিকে ঝুলে পড়া বা বেঁকে যাওয়া।
- A- আর্ম বা হাত। হঠাৎ হাত অসাড় লাগা, জিনিস পড়ে যাওয়া, হাতে জোর না পাওয়া।
- S- স্পিচ বা কথা। হঠাৎ কথা জড়িয়ে যাওয়া বা কথা আওড়ে যাওয়া।
- T- টাইম টু কল ৯১১। উপরের কোনও একটি উপসর্গ দেখা গেলেই সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী হাসপাতালে যেতে হবে।
- কী কী করবেন না?
উপরের কোনও একটা উপসর্গ দেখা দিলে সেটা হালকাভাবে নেবেন না।
- গ্যাসের উপসর্গ বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
- দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাওয়া যাবে না। অন্যথায় বিপদ বাড়বে।
- মুখে-চোখে জল দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।
- দ্রুত চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা দরকার।
স্ট্রোক হলে সঙ্গে সঙ্গে করণীয়
- যত দ্রুত সম্ভব নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।
- ব্রেন স্ট্রোকের প্রাথমিক চিকিৎসা বাড়িতে বা রাস্তাঘাটে করা যায় না।
- স্ট্রোক হলে মাটিতে শুইয়ে, মাথাটা উঁচু করে রাখতে হবে। গলার কাছে চাপা পোশাক থাকলে তা আলগা করে দিতে হবে।
- আক্রান্ত হওয়ার সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে থ্রম্বোসিস প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে।
- স্ট্রোক এড়াতে নিয়মিত শারীরিক কসরত করতে হবে।
- নিয়ম মেনে খাওয়া-ঘুম দরকার।
- ফাস্ট ফুড, ধূমপান, মদ্যপান এড়িয়ে চলুন।
- মানসিক চাপ এড়াতে কাজ থেকে দু-তিন মাস অন্তর ‘ব্রেক’ নিন।
- পরিবারের কারও স্ট্রোকের ইতিহাস থাকলে ২৫ বছর বয়সের পর থেকে নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার।
- ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়লে নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।