ডাক্তারবাবুর দেওয়া ওষুধ নিয়ম মেনে খেলে পাওয়া যাবে সুফল। কিন্তু সেই নির্দেশের একটু এদিক-ওদিক হলে ভয়ানক সমস্যা দেখা দিতে পারে। রোগী সুরক্ষিত ও সুস্থ থাকতে প্রেসক্রিপশন নির্দেশিত কোন তথ্যগুলি একেবারেই উপেক্ষা করবেন না। ‘সংবাদ প্রতিদিন’ কে জানাচ্ছেন ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজিস্ট অ্যান্ড পেসেন্ট সেফটি এক্সপার্ট ডা. শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক।
অসুস্থ হওয়া, চিকিৎসকের কাছে সময় মতো যাওয়া ও তারপর প্রেসক্রিপশন মেনে ওষুধ খাওয়া, অসুখ সারিয়ে ভাল থাকতে এটাই চিরাচরিত চেনা ছক। কিন্তু এই চেনা ছকের বাইরেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। যেগুলি ঠিকভাবে না মেনে নিজেদের অজান্তেই শরীরে অন্য রোগ ডেকে আনি। ২০১৯- এর ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (WHO) রিপোর্ট অনুযায়ী মেডিকেশন এরর, বা ওষুধের যথার্থ ব্যবহার না করার দরুন শারীরিক সমস্যা ও অসুস্থতার পিছনে সারা বিশ্বে খরচ প্রায় ২৯২ কোটি টাকার। এই তথ্য কপালে ভাঁজ ফেলার মতোই।
কারণ একাধিক ওষুধের ডোজ সম্পূর্ণ না করা, কিংবা সঠিক নিয়মে ওষুধ সেবন না করা অথবা নিজের মতো ওষুধ নির্বাচন ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ক্ষতি হয় আমাদের শরীর। আর তাতেই রোগীর উপর অন্য রোগের আনাগোনা শুরু হয়। ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে এধরনের ভুল বিপদ ডেকে আনতে পারে? ছক ভাঙলে চেনা ওষুধেও অসুখের হাতছানি।
ওষুধ সেবনের নিয়ম না মানলে ক্ষতি অনেক
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স
শরীরে কোথাও যদি সংক্রমণ হয় বা ত্বকে কোনও রকম ঘা হয় তখন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন জরুরি। এক্ষেত্রে চিকিৎসক যতদিনের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক খেতে বলবেন ততদিন খেতেই হবে। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ডোজ যদি নিজের ইচ্ছেমত কেউ সেবন করেন বা ডোজ শেষ না হওয়ার আগেই ওষুধ বন্ধ করে দেন তবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তার ফলে পরবর্তীকালে অসুস্থতার কারণে এই ওষুধ দেওয়া হলে তখন আর কাজ করে না।
ইনসুলিন প্রয়োগে ত্রুটি
ডায়াবেটিস বা রক্তে সুগারের মাত্রা ঠিক রাখতে বাড়িতে অনেক ডায়াবেটিস রোগীরা ইনসুলিন নেন। এক্ষেত্রে ইনসু্লিন সাবকিউটেনিয়াস রুট দিয়েই ইনজেকশন এর মাধ্যমে নিতে হবে। অনেকেই তা না করে সরাসরি ধমনীতে ইনজেকশন প্রয়োগ করে তাহলে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই ইনসুলিন নেওয়ার আগে তার সঠিক প্রয়োগ শেখা খুব জরুরি।
ওরাল মেডিকেশনে বিপদ যখন
বিভিন্ন অসুখের ক্ষেত্রে ভিন্ন ওষুধ খেতে হয়। এমন অনেক সময়ই হয় যে, কিছু ওষুধ খালিপেটে খেতে বলা হয়। সেই ওষুধ যদি কেউ ভরা পেটে খান, তার প্রভাব শরীরে উপর মোটেই ভাল নয়। ডায়াবেটিস রোগীদের এবিষয়ে খুব সতর্ক থাকা উচিত।
থাইরয়েডের ওষুধ সময়ে সেবন
অনেকেই সকালে খালিপেটে থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণের ট্যাবলেট খান। আসলে, সকাল বেলাতে আমাদের শরীরে যত রকম হরমোন আছে তা নিঃসৃত হয় (ক্রোনাফোর্মোকোলজি)। তাই সকালবেলায় থাইরয়েডের ওষুধ সবচেয়ে ভাল কাজ করে। এমনকী স্টেরয়েডও সকালে সেবন স্বাস্থ্যকর। তার বদলে কেউ যদি তা অন্যসময় বা সন্ধে বেলা খান তাহলে ওষুধের প্রয়োজনীয় কাজ হবে না।
উচ্চ রক্তচাপের ওষুধে সতর্ক হন
প্রতি ঘরে এই সমস্যা রয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়ম করে রোজ ওষুধ খেতেই হবে রোগীকে। ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলে ‘রিবাউন্ড’ ব্লাডপ্রেসার হবে। অর্থাৎ হঠাৎ করেই ব্লাড প্রেসারের মাত্রা বেড়ে গিয়ে স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে।
স্টেরয়েডের সাইড এফেক্ট
অ্যাজমা রোগী যারা স্টেরয়েড নিচ্ছে বা ইনহেলারের মাধ্যমে যাদের শরীরে স্টেরয়েড প্রবেশ করছে তাদের খুব সতর্কতার সঙ্গে তা ব্যবহার করতে হবে। কথায় বলে, স্টেরয়েড ‘ডাবল এজড সোর্ড’ অর্থাৎ দু’মুখো তলোয়ারের সমান। দু’দিক থেকে ক্ষতি করতে পারে। ইনহেলারের মাধ্যমে স্টেরয়েড নিলে তারপর মুখ ও গলা ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে। না হলে মুখে স্টেরয়েড থেকে গিয়ে ফাংগাল ইনফেকশন হতে পারে। এছাড়া স্টেরয়েড ডায়াবেটিস বা রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই যারা স্টেরয়েড নিচ্ছেন তাদের নিয়মিত বা তিনমাস অন্তর ব্লাড সুগার মাপা জরুরি। দীর্ঘ সময় ধরে স্টেরয়েড নিলে হাড়ের শক্তি হ্রাস পেতে পারে। সেক্ষেত্রে স্টেরয়েডের সঙ্গে ক্যালশিয়াম ট্যাবলেট খেয়ে যেতে হবে।
ওষুধ কেনার সময় বুঝে
যেকোনও ওষুধ কিনতে যাওয়ার আগে দেখতে হবে ওষুধ স্টোরেজ ঠিক রয়েছে কিনা। অর্থাৎ কোন ওষুধ ঠান্ডায় ভাল, কোন ওষুধ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ঠিক থাকে। কাজেই কেনার সময় দেখে নিতে হবে সেই সব খুঁটিনাটি বিষয়গুলি। যা মেনে ওষুধ স্টোর করা হয়েছে কি না। এছাড়া ভুয়া ওষুধ থেকে সাবধান। কারণ অনেক ওষুধের দোকানেই চিকিৎসক যে ওষুধ নির্দেশ করেন তার বাইরে গিয়ে অন্য কোম্পানির ওষুধ ক্রেতাদের ধরিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে খুব সম্ভাবনা থাকে ভুয়া ওষুধের চক্করে পড়ার। তাই প্রেসক্রিপশন বহির্ভূত ওষুধ একেবারেই খাওয়া যাবে না।
যদি অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে অন্য ওষুধ চলে
অ্যালোপ্যাথির ওষুধ খাচ্ছেন, সঙ্গে হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদিক ওষুধ যদি চলে তবে তা ডাক্তারবাবুকে জানাতে হবে। ড্রাগ ইন্টার্যাকশন হলে তাতে কোনও ওষুধই ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।
ওষুধের সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের যোগ নিবিড়
যেকোনও ওষুধ সেবনের পাশাপাশি তার সঙ্গে কী খাবার খাচ্ছেন সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- কিছু ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক (ডক্সিসাইক্লিন) রয়েছে, যা করোনা রোগীদের ও দেওয়া হচ্ছে সেই ওষুধ খেলে রোগীর দুধ খাওয়া চলবে না, অন্যদিকে প্রেগন্যান্ট মহিলাদের আয়রন ট্যাবলেট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে এই ট্যাবলেট খাওয়ার আগে পর্যাপ্ত খাবার খেতে হবে, তবেই ওষুধ খেলে তা কাজ করবে। আবার অ্যাসিডিটির ওষুধ(প্যান্টোপ্রাজল)সবসময় খালিপেটে খেলেই কাজ করবে। এক্ষেত্রে ভরা পেটে খেলে ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই ওষুধের পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসও খুবই জরুরি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.