শিশুর পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা সবেতেই থাইরয়েড গ্রন্থির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নাহলে ছোটবেলার থাইরয়েডের অসুখ সারাজীবনের স্বাভাবিকতা নষ্ট করতে পারে। বিস্তারিত জানালেন ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথের বিশিষ্ট পেডিয়াট্রিক সার্জেন ডা. পার্থপ্রতিম গুপ্ত। শুনলেন সুমিত রায়৷
শিশু অত্যন্ত চঞ্চল, ছটফটে মানেই তার শারীরিক কোনও সমস্যা নেই৷ তাদের এমন স্বভাবে বাবা-মায়েরাও নিশ্চিন্ত। শিশু যদি খুব দ্রুত লম্বা হতে থাকে সেটাও অভিভাবকের মনে তৃপ্তি জাগায়। যাক, শিশু তবে লম্বা হবে। অনেক সময় আবার এমনও দেখা যায়, তুলনামূলকভাবে সন্তানের সমস্ত বিকাশ স্বাভাবিকের চেয়ে কম হচ্ছে। তখন অনেকেই মনে করেন শিশুর বিকাশ আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত হবে ফলে ধৈর্য ধরে স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করেন। কখনও কখনও শিশু খুব দুর্বল স্বভাবের, ঘুমকাতুরে হয়। সেক্ষেত্রে অনেক মা,বাবাই মনে করেন, শিশু আরামপ্রিয়। শিশুর এহেন লক্ষণের পিছনে বাবা-মায়েদের মন গড়া এসব যুক্তি সবসময় কিন্তু ঠিক নাও হতে পারে। শিশুর থাইরয়েড গ্রন্থির সঠিক কাজ না করলে তখনও কিন্তু এই ধরনের সমস্যাগুলি দেখা যায়। তাই নিজ মতে শিশুর অস্বাভাবিকতার কারণ না খুঁজে থাইরয়েড না তো? ভেবে দেখুন।
থাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ
গলার কাছে প্রজাপতির মতো থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে টি-থ্রি এবং টি-ফোর নামক দু’টি হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোনের স্বাভাবিক নিঃসরণ হলে তাকে বলা হয় ইউথাইরয়েডিজম। হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ হলে সেক্ষেত্রে তা হাইপারথাইরয়েডিজম রোগ হিসাবে শনাক্ত করা হয় হল এবং হরমোনের ঘাটতি দেখা দিলে তখন রোগটিকে বলা হয় হাইপারথাইরয়েডিজম। জীবনে পরবর্তী সময়ে থাইরয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধি রোধ করতে শিশুকাল থেকে আয়োডিন যুক্ত নুন খাওয়ানোই একমাত্র উপায়।
অস্বাভাবিকতার পরিণাম
শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য থাইরয়েড হরমোনগুলি স্বাভাবিকতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই ছোট বয়স থেকেই এই হরমোনের নিঃসরণে কোনও গন্ডগোল দেখা দিলে শিশুর শরীরের প্রত্যেকটি তন্ত্রের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়। শিশুর ক্ষেত্রে হাইপোথাইরয়েডিজম হলে তার মস্তিষ্ক, হার্ট, স্নায়ু এবং মাংসপেশীর বিকাশ অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং সেটা যদি সঠিক সময় শনাক্ত না হয়, সেক্ষেত্রে সেই শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ ঠিক মতো হয় না। বয়স বৃদ্ধি হলেও সে শিশুর মতোই বেঁটে থাকে। এই রোগকে বলা হয় ‘ক্রিটিনিজম’।
উপসর্গ চিনুন
– হাইপো বা হাইপার থাইরয়েডিজম দু’ক্ষেত্রেই– শিশুর অন্যমনস্ক, একাগ্রতার অভাব দেখা যায়। অর্থাৎ শিশুরা অ্যাটেনশন ডেফিসিট ডিজঅর্ডারে ভোগে(এডিডি)।
– হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে জন্মানোর পরই পরীক্ষা না করলে, কয়েক মাস বা কয়েক বছর বয়সের মধ্যে (১৪ বছর বয়সেও) উপসর্গগুলি সামনে অাসতে পারে। শিশু যখন কথা বলতে
পারছে না সেই বয়সে এই থাইরয়েডের প্রথম উপসর্গ হল কোষ্ঠকাঠিন্য। কথা বলতে শিখলে তখন কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্লান্তি ও খুব ঘুমকাতুরে স্বভাবের প্রকাশ ঘটে। একটু তাপমাত্রা কম হলেও হুহু করে শরীর কাঁপে। মুখে ফোলা ভাব, রুক্ষ চুল, সহজে চুল উঠতে থাকলে সতর্কতা জরুরি।
– হাইপারথাইরয়েডিজম হলে গলার কাছে একটা মাংসপিণ্ড বেরিয়ে থাকে, যে রোগকে গয়টার বলা হয়। এক্ষেত্রে শিশু ঘুম কম হয়, অল্পতেই প্রচণ্ড উত্তেজিত ও বিরক্ত হয়ে ওঠে, গরম সহ্য করতে পারে না, ঘাম হয় বেশি, ডায়েরিয়ার সমস্যা, হাড় সহজেই ভঙ্গুর হয়, হাত-পা কঁাপতে থাকে, অল্প দৌড়োদৌড়ি করলেই বুক ধড়ফড় করে, চোখে দেখতে অসুবিধা হয় এবং চোখ অল্প বেরিয়ে আসে।
কখন, কীভাবে নির্ধারণ?
শিশুর জন্মের পরই গোড়ালি থেকে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। যদি হাইপোথাইরয়েডিজম ধরা পড়ে, তখনই অার একটা রক্ত পরীক্ষা করে যাচাই করা হয় যে, কেন এই গ্রন্থি কাজ করছে না। সেক্ষেত্রে দেখা হয়, মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত টিএসএইচ হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই গ্রন্থির কাজ করতে কোনও সমস্যা না কি টি—থ্রি বা টি—ফোর হরমোনের সমস্যা। নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী ওষুধ দেওয়া হয়। জন্মের ৫ থেকে ৭ দিনের মধে্য ওষুধ শুরু করলে এই হরমোন শরীরে উৎপন্ন হয়ে শিশুর সর্বাঙ্গিক বিকাশে সাহায্য করে। শনাক্ত হতে বছর দুয়েক দেরি হলে, তখন ওষুধ চালু
করলেও শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের খামতি মেটানো অসম্ভব।তবে হাইপারথাইরয়েডিজিমে খুব কম শিশুই আক্রান্ত হয়। এই রোগের প্রকাশ দেরিতে হয়। সেক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষা, আলট্রাসোনোগ্রাফি এবং স্ক্যান করে নির্ধারণ সম্ভব।
সারা জীবন ওষুধ খেতে হবে?
হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে শিশুর জন্মের পর থেকে সারা জীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের ডোজ পাল্টাতে থাকে। হাইপারথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে যদি স্ক্যান করে দেখা যায় যে, গ্রন্থি একটা জায়গায় প্রচণ্ড বেশি কাজ করছে তখন সার্জারির মাধ্যমে সেটা বাদ দিতে হয়। এবং এই সার্জারির পর অার রোগীকে ওষুধ খেতে হয় না।
সাবধানতা
– বাড়ন্ত শিশুর চারিত্রিক কোনও অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে কি না তা বাবা-মায়ের নজরে রাখা জরুরি।
– শিশুর বৃদ্ধি বা মনের বিকাশ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বা কম হলে সতর্ক হল।
– হাইপোথাইরয়েডিজম বা হাইপারথাইরয়েডিজম যাই হোক না কেন, শিশু থেকে বড় বয়স পর্যন্ত সারাজীবন চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলতে হবে।
– হাইপারথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে মাংসপিণ্ড থাকলে ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা থাকতে পারে।
– শিশুর হাইপোথাইরয়েডিজম হলে, বংশে কারও আগে হাইপোথাইরয়েডিজম ছিল কি না সেটা জানা প্রয়োজন।
– একমাত্র আয়োডিনই থাইরয়েড রোগ থেকে বাঁচাতে পারে। সুতরাং গর্ভবতী মা এবং জন্মের পর শিশুকে আয়োডিনযুক্ত নুন খাওয়ানো জরুরি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.