অভিরূপ দাস: ভাইরাস ঢোকেনি। দুশ্চিন্তা ঢুকেছে। তাতেই খালি হয়ে যাচ্ছে মাথা। এসএসকেএম, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ভিড় করছেন কেশহারারা। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার এই ভিড় তিন গুণ। করোনায় ফুসফুস বিকল হওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক। কিন্তু চুল (Hair) পাতলা হয়ে যাওয়া? ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ত্বকরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. অভিষেক দে জানিয়েছেন, হাসপাতালে গড়পড়তা রোজ পঞ্চাশ থেকে ষাটজন এমন রোগী আসছেন। জিজ্ঞেস করলে বোঝা যাচ্ছে কোভিড আতঙ্কে এঁরা থরহরি কম্প।
আতঙ্কে চুল পড়ার একটি বিশেষ প্যাটার্ন রয়েছে। সে প্যাটার্নই দেখা যাচ্ছে নতুন কেশ হারানো রোগীদের মাথায়।
চিকিৎসকরা বুঝতে পারছেন আতঙ্কেই পড়ছে চুল। চিকিৎসা পরিভাষায় যে অসুখের নাম টেলোজেন এফ্লুভিয়াম (Telogen Effluvium)। মানুষের মাথায় প্রায় একলক্ষ চুল থাকে। এই চুলের সাধারণত তিনটি ভাগ। অ্যানাজেন, টেলোজেন আর ক্যাটাজেন। সবচেয়ে সতেজ চুল থাকে অ্যানাজেন অংশে। শহরের বিশিষ্ট ডার্মাটোলিজস্ট ডা. কৌশিক লাহিড়ী জানিয়েছেন, যাঁরা আসছেন অত্যধিক মানসিক চিন্তায় তাদের অ্যানাজেন অংশ থেকে মাথার নিস্ক্রিয় টেলোজেন অংশে চুল প্রবেশ করছে। আর তার ফলে মাথায় হাত দিলে কিংবা চিরুনি ছোঁয়ালেই উঠে আসছে গোছা গোছা চুল।
সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি ছবি চমকে দেওয়ার মতো। যেখানে দেখা যাচ্ছে করোনাকালে (Coronavirus) ক্রমশ খালি হয়ে আসছে পৃথিবীর মাথা। শহরের বিশিষ্ট ডার্মাটোলিজস্ট ডা. কৌশিক লাহিড়ীর অভিজ্ঞতায়, “আগে চেম্বারে দিনে পাঁচজন চুল পড়ার সমস্যা নিয়ে এলে এখন সে সংখ্যাটা কুড়ি। সকলেই বলছেন, গত তিনমাস ধরে প্রচুর চুল পড়ছে। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে প্রায় চারগুণ বেড়ে গিয়েছে চুলপড়ার অসুখ। কোভিডে অনেকে চাকরি খুইয়েছেন। তার থেকেও তৈরি হয়েছে স্ট্রেস। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও চুল হারানোর জন্য দায়ী বলে জানিয়েছেন ডা. লাহিড়ী।
টালিগঞ্জের দিবাকর মল্লিক থেকে, বৈঠকখানা রোডের ধ্রুব ঘোষ আচমকা চুল পড়ার সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন ন্যাশনালে। উভয়কেই হেয়ারপুল টেস্ট করতে বলা হয়েছিল। টেলোজেন এফ্লুভিয়াম ধরতে এই টেস্টই করা হচ্ছে। ফলাফল দু’জনেরই পজিটিভ। রোগীদের শারীরিক পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে শুধু মেন্টাল স্ট্রেস নয়, ফিজিক্যাল স্ট্রেসও চওড়া করছে কপাল। গত অক্টোবরে কোভিড হয়েছিল, সেরে উঠেছেন, এমন মানুষও আসছেন চুল পড়ার সমস্যা নিয়ে। ডা. অভিষেক দে জানিয়েছেন, কোভিড হওয়ার চার থেকে ছ’সপ্তাহ বাদে অনেকের চুল পড়ছে। আসলে করোনাকালে ওই ব্যক্তি অত্যধিক দুশ্চিন্তা করেছিলেন। তারই ফলাফল দেখা যাচ্ছে চার থেকে ছ’সপ্তাহ পরে। এর জন্য ফিজিক্যাল স্ট্রেস দায়ী।
এই চুল হারানোর ইতিবাচক দিক একটাই। আতঙ্কের কারণে পড়ে যাওয়া এই চুল ফিরে আসা সম্ভব। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ডার্মাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রমেশচন্দ্র ঘরামির কথায়, দুশ্চিন্তার কারণে প্রতিদিন কত চুল পড়বে তার কোনও সহজ হিসাব নেই। সাধারণত প্রতিদিন ১০০ চুল পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেই অনুযায়ী চুল যদিও গজাচ্ছে না অনেকেরই। তখনই শুরু হচ্ছে সমস্যা। অতিমারী শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চুল পড়ে না। যে কোনও আতঙ্কের আবহ তৈরি হওয়ার পর চুল পড়া শুরু হতে মাস চারেক সময় লাগে। বাস্তব চিত্রও বলছে মার্চ থেকে শুরু হওয়া আতঙ্কে চুল পড়ার রোগীর আনাগোনা শুরু হয়েছে জুলাইয়ের শেষ থেকেই।
শুধুমাত্র কোভিডের আতঙ্কই যে শহরের মাথা খালি করে দিচ্ছে এমনটা মানতে রাজি নন বিশেষজ্ঞরা। এমন অনেক রোগীও আসছেন স্ট্রেস ছাড়াও যাঁদের চুল আচমকাই পড়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এঁদের মধ্যে স্ট্রেস নেই কিন্তু হঠাৎই নানা ভিটামিনের অভাব দেখা গিয়েছে। ডা. অভিষেক দে কথা বলেছেন এমন রোগীদের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করে জানা গিয়েছে কোভিড আবহে বাড়ির পরিচারিকা ছাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকে। ‘সিমপ্লিফায়েড’ অথবা সহজে রান্না করা যায় এমন খাবার খাচ্ছেন। যার থেকে চুলের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন বি১২ অথবা ডি ৩ আসছে না। অবিলম্বে খাদ্যাভাস বদলাতে বলা হয়েছে তাঁদের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.