বাত যখন চোখে পৌঁছায়, সময়মতো চিকিৎসা না করালে দৃষ্টিশক্তিও লঘু হয়। কোন লক্ষণগুলো প্রকট হলে সাবধান হওয়া প্রয়োজন, সেই বিষয়ে সবিস্তার জানালেন রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অপথালমোলজির অধিকর্তা ডা. অসীমকুমার ঘোষ। তাঁর কথা লিপিবদ্ধ করলেন মৌমিতা চক্রবর্তী।
চোখের ইউভিয়াল টিস্যুর প্রদাহ হল ইউভিআইটিস (Uveitis)। সাধারণত যাঁদের বাতের সমস্যা রয়েছে তাঁদের বাত থেকে চোখে এই প্রদাহ হয়। কী হয়? চোখের সামনের স্বচ্ছ অংশ হল কর্নিয়া, তার পরবর্তী গহ্বরটি হল অ্যান্টেরিয়র চেম্বার, তার পরের ধাপে বাদামী রঙের পর্দা থাকে, যাকে পিউপিল বলা হয়। যার মধ্যে শিরা, পেশি, নার্ভ ও সেল প্রভৃতি থাকে। সেই স্থানের প্রদাহই হলো ইউভিআইটিস।
ইউভিয়াল টিস্যুর সামনের অংশ হল আইরিশ, এর প্রদাহ হল আইরাইটিস। তার পরের পর্যায় আসে সিলিয়ারি বডি। যার প্রদাহ হল সাইক্লাইটিস এবং শেষ ধাপ হল কোরোয়েড। এখানে প্রদাহ হলে হয় কোরোয়েডটাইটিস। চোখের এই তিন প্রকার প্রদাহকে একসঙ্গে ইউভিআইটিস বলে।
লক্ষণ
সাধারণত মাঝবয়সি বা ৩০-৪০ বছর বয়সিদের ইউভিআইটিসের প্রবণতা দেখা যায়। এতে মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হন। কখনও একটি বা দু’টি চোখই লাল হওয়া, জল পড়া, চোখের পাতা সামান্য ফোলা, আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা বা ফোটোফোবিয়া এবং দৃষ্টিশক্তি কিছুটা ব্যাহত হওয়া, সারাদিন বিশেষ করে রাতে চোখে দপদপে ব্যথা এর প্রাথমিক লক্ষণ।
কেন হয়?
ইউভিআইটিসের সঙ্গে সরাসরি চোখে বাত হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। যাঁদের শরীরে বাতের লক্ষণ থাকে অর্থাৎ অটোইমিউন বাত রোগ থাকলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রোগীর চোখ-সহ বিভিন্ন টিস্যুর উপর আক্রমণ করে। আর্থ্রাইটিস, স্পন্ডিলাইটিস, অ্যানকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস ইত্যাদির ফলে কমবয়সি পুরুষদের কোমরে ও ঘাড়ে ব্যথা ছাড়াও শরীরের মধ্যে ইমিউনোলজিক্যাল বা ইমিউনো মডিউলেশন হতে থাকে।
হাড় ও হাড়ের পাশে অবস্থিত কার্টিলেজ ও পেশির সম উপাদান টিস্যু আমাদের ইউভিয়ায় উপস্থিত। তাই হাড়ে সৃষ্ট প্রদাহের কারণে তৈরি অ্যান্টিবডি রক্ত স্রোতের মাধ্যমে বইতে থাকার সময় নিজের সমগোত্রীয় টিস্যু খুঁজে পেলে ইউভিয়ায় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ফলে চোখে প্রদাহ হয়।
এছাড়া কারও যদি আগে টিবি রোগ হয়ে থাকে তবে টিস্যুগুলো সংবেদনশীল হয়ে যাওয়ায় টিবির জীবাণু নতুন করে সক্রিয় হলে চোখের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দিতে পারে।
৮৫% ক্ষেত্রে ইউভিআইটিস হওয়ার কোনও কারণ বোঝা যায় না, যাকে নন-গ্রানুলোম্যাটাস বলে। বাকি ১৫% ক্ষেত্রে কিছু ব্যাকটিরিয়া গঠিত কারণে হয়, যা গ্রানুলোম্যাটাস নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে সরাসরি কোনও ইনফেকশন থেকে যেমন-টিবি, সিলিফিস, লেপ্রসি, এইচআইভি, হারপিস, চিকেন পক্সের মতো ভাইরাস থেকেও ইউভিআইটিস হতে পারে। HIV রোগীর ক্ষেত্রে ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি অর্থাৎ হঠাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে গেলে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস নানা প্রকারে টিস্যুকে আক্রমণ করে তার মধ্যে আইরিশ একটি অন্যতম টিস্যু। যার থেকে রেটিনাইটিস, আইরাইটিসের মতো ইনফেকশন হয়।
চোখে হঠাৎ কোনও আঘাতের কারণে ও ছানি অপারেশনের পর ইউভিআইটিস হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে রুবেলা ভাইরাস থাকলে টিকা না নেওয়ার দরুন গায়ে র্যাশ ও জ্বর হলে গর্ভজাত সন্তান সেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল ইউভিআইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা শিশুদের জন্মগত রোগ। শুধু বড়দের নয়, শিশুদেরও রিউমাটয়েড আর্থাইটিস হয়, এতে শিশুর গলাব্যথার সাথে জয়েন্ট পেইন হয় ও ফলস্বরূপ শিশু ইউভিআইটিসে আক্রান্ত হয়।
চিকিৎসা
লক্ষণ দেখা দিলে প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রথমবারের উপশমের পর ইউভিআইটিস আবার ফিরে আসতে পারে। তাই সঠিক চিকিৎসা না করালে অল্প বয়সেই ছানি পড়তে পারে। এছাড়া রেটিনারও অনেক ক্ষতি হতে পারে। তা থেকে চিরকালীন অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। গ্লকোমাও দেখা দিতে পারে।
ওষুধের ক্ষেত্রে স্টেরয়েড আইড্রপ, অ্যাট্রোপিন ড্রপ দেওয়া হয়। কখনও খাওয়ার ওষুধের মাধ্যমেও স্টেরয়েড দেওয়া হয়।
সমস্যা বেশি হলে ছানির সঙ্গে গ্লকোমার অপারেশন করা হয়। শরীরে বাতের প্রবণতা থাকলে ইউভিআইটিস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও রিউমাটোলজিস্টের পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা প্রয়োজন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.