মস্তিষ্কই চালিকাশক্তি। এর ডেভলপমেন্ট যদি ঠিকমতো না হয় তবে শিশুর পেশিও সচলতা হারাতে পারে। শিশুদের বিশেষ অসুখ হাইপারটোনিয়া নিয়ে জরুরি তথ্য তুলে ধরলেন অর্থোপেডিক ডা. অর্ণব কর্মকার। লিখলেন জিনিয়া সরকার।
শিশুকে কিছুতেই ন্যাপি পরানো যাচ্ছে না। শত চেষ্টা করেও তার পায়ের স্বাভাবিক মুভমেন্ট করা মুশকিল হচ্ছে। পা আড়ষ্ট করে রেখে দেয়। এটা দীর্ঘদিন করলে মোটেই সেটাকে শিশুর দুষ্টুমি ভাববেন না। এই ধরনের লক্ষণগুলি শিশুর একটি জটিল সমস্যার ইঙ্গিতবাহী। যার নাম হাইপারটোনিয়া। অর্থাৎ টোনড মাসেল অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে যাওয়া।
ঠিক কী হয়?
যে সব পেশি আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাঁজ করতে সাহায্য করে, সেটা হাত-পা, হাঁটু-কনুই কিংবা শরীরের যে কোনও স্থানে হোক, দেখা যায় সেটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কাজ করছে, তাই স্বাভাবিক সচলতাও ব্যাহত হচ্ছে। বেশি টাইট হয়ে থাকে। এমনকী বিশ্রাম নেওয়ার সময়ও এমন অবস্থাতেই থাকে।
এটি মূলত ব্রেনজনিত বা স্নায়ুজনিত একটি সমস্যা বলা যায়। এর মূল কারণ জন্মের পর মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত হওয়া। সদ্যোজাতর ব্রেনে অক্সিজেন ঠিকমতো না পৌঁছলে বা হাইপক্সিক ইনজ্যুরির জন্য পেশির টোনড ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। সাধারণত সেরিব্রাল পলসি অসুখে অক্সিজেনের অভাব ঘটে। পেশি কখন কতটা সক্রিয় থাকবে, কতটা আলগা হবে বা হবে না এই পুরো নিয়ন্ত্রণটাই মস্তিষ্ক থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। অক্সিজেন সরবরাহ ঠিকমতো না হলে শুরুতেই ব্রেনেই এই নিয়ন্ত্রণশক্তি দুর্বল হয়ে যায়। ফলে পেশির টোনড ঠিক থাকে না। দেখা দেয় হাইপারটোনিয়া।
কখন সতর্ক হবেন?
শিশু যদি জন্মের পর না কাঁদে তা হলে সতর্ক হন। কারণ শিশু যদি না কাঁদে বা কাঁদতে দেরি করে, তা হলে হার্ট ঠিকমতো পাম্প করতে পারে না। রক্তসঞ্চালন ঠিকমতো কার্যকর হতে যে শক্তি প্রয়োজন সেটাও ঠিকমতো হয় না। ফলে পেশির সমস্যা প্রকট হয় ও হাইপারটোনিয়া প্রকাশ পায়।
কারণ
নানা কারণে এই সমস্যা হতে পারে।
প্রথমত, জন্মগত ত্রুটি। যে কারণে শিশুর প্রথম কান্না খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা না হলে সমস্যা বাড়ে।
দ্বিতীয়ত, সন্তান প্রসবের সময় মায়ের জটিলতা, সন্তান গর্ভে থাকাকালীন ফ্লুইড গিলে নিলে গলায় আটকে শিশুর জন্মের সময় অসুবিধা প্রকাশ পেতে পারে।
তৃতীয়ত, জন্মগত ত্রুটি। যেমন শিশুর ফুসফুস, হার্টে কোনও রকম সমস্যা
থাকলে ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না। তা থেকে এই অসুখ হয়।
চতুর্থত, শিশুর জন্মের পর জন্ডিস খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে অর্থাৎ বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে সেক্ষেত্রে এমন পেশিগত সমস্যা পরবর্তীকালে প্রকাশ পায়।
পঞ্চমত, শিশুর একটু বড় বয়সে কিছু অসুখ আসে সেগুলি হলে তা থেকেও কিন্তু হাইপারটোনিয়া প্রকাশ পায়। যেমন, ব্রেন ইনফেকশন বা ম্যানিনজাইটিস, টিউবারক্যুলোসিস ইত্যাদি— সেগুলি থেকে ব্রেন ড্যামেজ হতে পারে, মাথায় কোনও আঘাত থেকে ব্লাড ক্লট করে গেলে তা থেকেও অক্সিজেনের অভাবে পেশির সমস্যা প্রকাশ পায়।
স্ট্রোক হলে তা থেকেও কিন্তু হাইপারটোনিয়া হয়। পেশির উপর মস্তিষ্কের যে নিয়ন্ত্রণ, সেটা নষ্ট হয়ে যায়।
তবে অসুখটা কতটা পরিমাণে একজনের উপরে প্রভাব ফেলবে, তা নির্ভর করে মস্তিষ্কের কোন অংশে কতটা অসুবিধা থেকে সমস্যাটি হচ্ছে তার উপর।
কাঁধে, চোখে, হাতে, আঙুলে, হাঁটুতে, কোমরে শরীরের যে কোনও স্থানের পেশিতে হাইপারটোনিয়া দেখা দেয়।
প্রতিকার সম্ভব?
এই অসুখ পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। কারণ, মস্তিষ্কের কোষ একবার ড্যামেজ হলে সেটা পুরোপুরি ঠিক করা যা না। তাই প্রতিরোধের ব্যাপারে সকলের জানা দরকার। সন্তান প্রসবের সময় সঠিক চিকিৎসক ও উন্নত পরিষেবাযুক্ত স্থানে চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। গর্ভাবস্থায় অ্যান্টিন্যাটাল স্ক্রিনিং জরুরি। তাহলে আগে থেকেই জেনে নেওয়া যায় শিশুর ফুসফুস, হার্টে কোনও সমস্যা রয়েছে কি না, সেই মতো সাবধান হওয়া যায়।
শিশুর বৃদ্ধিতে কোনও অসামঞ্জস্য দেখা গেলে সতর্ক হতে হবে। পরিবারিক সূত্রে কারও এমন সমস্যা থাকলে আরও বেশি সতর্ক থাকুন। সিটি স্ক্যান ও এমআরআই করে দেখা হয় ব্রেনের কোথায়, কতটা সমস্যা থেকে হাইপারটোনিয়া হচ্ছে। সেইমতো ওষুধ ও ইনজেকশন দ্বারা অসুখকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এছাড়া বিহেভিহারাল থেরাপি ও ফিজিওথেরাপি এ ক্ষেত্রে খুব কার্যকর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.