শিশুদের নানা অসুখের পিছনে দায়ী রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। জিনঘটিত বা অন্যান্য কারণে যদি দুর্বল হয় ইমিউনিটি তাহলে কিন্তু আজীবন এর মাশুল গুনতে হয়। কী করলে শিশুরা সুস্থ ও শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেমের অধিকারী হতে পারে, আর অবহেলায় কতটা জটিল হতে পারে অসুখ—এই বিষয়েই আলোকপাত করলেন এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইমিউনোলজি অ্যান্ড রিউম্যাটোলজির (এআইআইআর) পেডিয়াট্রিক ইমিউনোলজিস্ট ডা. সঞ্জীব মণ্ডল। লিখলেন জিনিয়া সরকার।
অরিত্রিকের বয়স মাত্র তিন বছর। কিন্তু গত একবছর ধরে প্রায় তিনবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। প্রতিবারই নিউমোনিয়া খুবই সিরিয়াস পর্যায়ে গিয়েছে। এতটাই বাড়াবাড়ি যে, প্রতিক্ষেত্রেই ইনজেকশন, অ্যান্টিবায়োটিক না দিয়ে সেটা কোনওভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। তার পর চিকিৎসা করাতে এলে নানা কিছু টেস্ট করার পাশাপাশি রোগীর হিস্ট্রি নেওয়া হলে জানা গেল শিশুর সম্পর্কে এক মামার খুব অল্প বয়সে বারবার ইনফেকশন হওয়ার সমস্যা ছিল, এমনকী নিউমোনিয়া হয়ে মারাও গিয়েছেন তিনি। তারপর শিশুর টেস্ট রিপোর্টে দেখা গেল সে একটা ইমিউন ডেফিসিয়েন্সিতে আক্রান্ত। জিনঘটিত সমস্যার কারণে রক্তে ইমিউনোগ্লোবিউলিনের মাত্রা কম, সেই কারণেই বারবার ইনফেকশন হচ্ছে ও তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এমন বহু সমস্যা রয়েছে শিশুদের, যেগুলি জিনঘটিত কারণে ইমিউনিটির দুর্বলতা থেকে হতে পারে। ঠিক কী কাজ করে ইমিউনিটি? জন্মের পর থেকেই শরীরের যেকোনও স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ যদি একটুও বিচ্যুত হয় তা হলে শরীরকে লড়াই করতে হয়। যেমন কোনও পারিপার্শ্বিক সংক্রমণ, যেটার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকাটাই আসল। আর এই লড়াইয়ের পথে অন্যতম সঙ্গী হল ইমিউন সিস্টেম। একজন শিশু যখন বড় হয়ে ওঠে, সেই বেড়ে ওঠার সময়টায় অন্তর্বর্তীকালীন জ্বর, সর্দিকাশি ক্রমশ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে মজবুত করে ও আলাপ করিয়ে দেয় ভবিষ্যতের সংক্রমণরূপী শত্রুকে। এই সিস্টেমটাই যদি ঠিক না থাকে তাহলে সে সংক্রমণ হোক বা অন্যকিছু তা কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না।
ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি কতটা ভয়াবহ?
এটি আসলে জিনঘটিত জন্মগত সমস্যা। এক্ষেত্রে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি থাকে। তবে শুধু ছোটরা নয়, বয়স্করাও জন্মগত অনাক্রম্যতা বা ইমিউন ডেফিসিয়েন্সির শিকার হতে পারেন। এখনও অবধি এই রোগগুলি বিরল ব্যাধি (যে রোগে প্রতি একহাজার বা তার বেশি জনসংখ্যায় একজন আক্রান্ত হন) বলেই পরিচিত। সত্যিই কি তাই? পাশ্চাত্যের পরিসংখ্যান অনুযায়ী (প্রতি ১২০০ জনে একজন আক্রান্ত) পশ্চিমবঙ্গে সম্ভাব্য জন্মগত অনাক্রম্যতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক লক্ষের বেশি। পাশ্চাত্যের নিরিখে প্রাচ্যের সংখ্যাতিরিক্ত সঙ্গতিপূর্ণ বিবাহপ্রথা এ জাতীয় রোগের ব্যাপ্তির কারণ। যদিও এখন প্রতিদিনই নিত্যনতুন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। দুঃখজনক ঘটনা যে, রোগ বা রোগের আধুনিক চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ার পিছনে অন্যতম কারণ মানুষের সচেতনতার অভাব। একটু সচেতন হলেই শিশু শরীরে এই ধরনের ইমিউন ডেফিসিয়েন্সির সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
যে যে লক্ষণে সজাগ হবেন
শিশুর মধ্যে নিম্ন উল্লেখিত উপসর্গ দেখা মাত্রই ইমিউনোলজিস্টের পরামর্শ নিন।
বারবার সংক্রমণ।
সংক্রমণ হলেই বাড়াবাড়ি।
অস্বাভাবিক জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত।
বারবার অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার।
সংক্রমণ প্রশমনে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা।
একাধিকবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত, কান দিয়ে পুঁজ পড়া, মুখের ভিতরে প্রদাহ।
বারবার ডায়েরিয়া, পায়খানার সঙ্গে রক্তপাত।
ত্বক ও শরীরের অস্বাভাবিক স্থানে (যকৃৎ, কিডনি, মস্তিষ্ক) পুঁজ জমা।
বয়স অনুযায়ী ওজন ও উচ্চতার অসামঞ্জস্য।
অনিয়ন্ত্রিত অ্যালার্জি, ঠোঁট ফুলে যাওয়া।
কোনও ভারী অসুখ নেই অথচ একজনের রক্তে হঠাৎ করেই শ্বেত রক্তকণিকা ও অনুচক্রিকার মাত্রা কমে গেলে।
শিশু যদি উপরোক্ত যেকোনও দুই বা তার বেশি সমস্যায় আক্রান্ত হয়, তাহলে অবশ্যই জেনে নিন আপনার সন্তানটি সুরক্ষিত আছে তো? দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এগুলি সবই কিন্তু ইমিউনিটি বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতি জানান দেয়। আর একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। অনেক বাচ্চাই দেখবেন অহরহ জ্বর, গলাব্যথা, টনসিল বেড়ে যাওয়া, গলায় গ্ল্যান্ড ফোলা ও মুখের প্রদাহে আক্রান্ত হয়। এদের অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। অথচ রোগটি সার্বিকভাবে আলাদা – ‘পিফাপা’, একটি অটোইনফ্লেমেটরি ডিজিজ’। এই রোগ যদি সঠিক সময়ে ধরা না পড়ে ও চিকিৎসা শুরু না হয় তাহলে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহে কিডনি জোড়া অকালে বিকল হয়ে নানা সমস্যা শুরু করে। তাই এই চলতি লক্ষণগুলো স্বাভাবিক ভেবে ফেলে না রেখে রোগ নির্ণয় করে উপযুক্ত চিকিৎসা করা দরকার।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান উন্নতিসাধন, রোগ নির্ণয় পদ্ধতির সহজপ্রাপ্যতা আজ বিরল রোগ নির্ধারণকে সহজ করেছে। আরও ভালো যে, পূর্ব ভারতে কলকাতায় ইমিউনোলজি ল্যাব রয়েছে। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন হাতের কাছেই আছে। সচেতন হলে সুস্থ হয়ে ওঠা কোনও কঠিন ব্যাপার নয়।
যেগুলি করণীয়
ইমিউনিটি দুর্বল হলে নানা অসুখের প্রকোপ পড়ে। অনাক্রম্যতা বা দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলে পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস জরুরি। পাশাপাশি শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন, কাঁচা ফল, সবজি দেবেন না। এরূপ জিনবাহিত ব্যাধিতে পরিবারের একাধিক সদস্য আক্রান্ত হতে পারেন। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবারের অন্যান্য সদস্য, বাচ্চা ও গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের জিনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বাচ্চাগুলি অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টি-ফাংগাল প্রোফাইল্যাক্সিসে ভালো থাকে। কিছু রোগীর জন্য মাসিক অ্যান্টিবডি (ইমিউনোগ্লোবিউলিন) জীবনদায়ী পথ্য। আবার অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনই একমাত্র ভরসা। তবে অনেকক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ একটা বড় বাধা। আশার আলো ‘বিরলরোগ নীতি’ দ্বারা সরকারি আর্থিক সহায়তা এবং দামি জীবনদায়ী ওষুধ মেলে। এছাড়াও বিভিন্ন এনজিও, বিমা সংস্থার দ্বারা এই চিকিৎসায় সুলভে ও সহজে করা সম্ভব।
ইমিউনিটি দুর্বল হলে কীসের প্রকোপ পড়ে? জানালেন ডা. অর্ঘ্য চট্টোপাধ্যায় ইমিউনোলজিস্ট এআইআইআর।
এজাতীয় রোগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসা না শুরু হলে বিপদ আছে। সামান্য সংক্রমণ হলেও রোগীর এমন অবস্থা হয় যে, তাকে আইসিইউতে রাখতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিক অনেক সময় কাজ করে না, ফলে প্রাণসংশয় দেখা দিতে পারে। এই শিশুগুলির অটোইমিউন ডিজিজ (লুপাস, আর্থ্রাইটিস) এবং রক্তঘটিত ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। এছাড়া ফুসফুসেও বারবার সংক্রমণ ঘটে ফলে ব্রংকাইটিস, প্রদাহজনিত সমস্যা প্রকোট হয়। তবে বর্তমানে অনেক উন্নত চিকিৎসা রয়েছে যেগুলি এই কঠিন অসুখ প্রতিহত করতে সাহায্য করে। শুধু সময়ে চিকিৎসা শুরু করা দরকার।
ফোন – ৯১৪৭১৭৪৮৮৮
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.