যোগের (Yoga) জাদুতে মুগ্ধ অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসকরাও। কীভাবে হল যোগের বিশ্বায়ন? আন্তর্জাতিক যোগ দিবসের আগে বিশ্লেষণে গৌতম ব্রহ্ম।
যোগের জাদুতে বিশ্বকে এক পরিবার হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে ভারত। ২১ জুন আন্তর্জাতিক যোগ দিবসের স্লোগানই এই দর্শনকে সামনে রেখে। ‘যোগা ফর বসুধৈব কুটুম্বকম’। এ কি যোগের বিশ্বায়ন, না বিশ্বের যোগায়ন? কীভাবে হল এই ‘যোগায়ন’?
কেন্দ্রের আয়ুশ নীতি যদি কারণ হয়, আরও একটা কারণ অবশ্যই মডার্ন মেডিসিন-সহ অন্য প্যাথির চিকিৎসকদের যোগের প্রতি আস্থা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেঙ্গালুরুর নিমহনস, সল্টলেকের নেফ্রোকেয়ার থেকে দিল্লির এইমস, সর্বত্রই যোগের জয়জয়কার। সর্বত্রই অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে যোগ, প্রাণায়ম, ন্যাচারোপ্যাথিকে অন্তর্ভুক্ত করে শুরু হয়েছে ইন্টিগ্রেটেড থেরাপির অনুশীলন। যার মূল দর্শন রোগ থেকে মুক্তি এবং সেই রোগমুক্তির স্থায়িত্ব। কোন থেরাপিতে নিরাময়, তা বিচার্য নয়।
বহু স্বনামধন্য অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক ছুঁৎমার্গ পেরিয়ে এই মন্ত্রেই মিশ্র থেরাপি দিচ্ছেন। তৈরি হয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর যোগা থেরাপিস্টস’ (আইএওয়াইটি)। বিদেশের মাটিতে যোগের জয়পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন আমেরিকার ভাসকুলার সার্জন ডা. দিলীপ সরকার, হার্ভার্ডের ‘ডিভিশন অফ স্লিপ মেডিসিন’-এর অধ্যাপক ডা. সতবীর সিং খালসা, আমেরিকার কার্ডিওলজিস্ট ডা. ইন্দ্রনীল বসুর মতো চিকিৎসক।
কলকাতাতেও একাধিক মডার্ন মেডিসিনের চিকিৎসক নিয়মিত যোগ-প্রাণায়ম প্রেসক্রাইব করছেন। নেফ্রোলজিস্ট ও রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জন ডা. প্রতিম সেনগুপ্ত কিডনির অসুখের মোকাবিলায় বহুদিন ধরে যোগ-প্রাণায়াম করাচ্ছেন। শুরু করেছেন ‘মুক্তি’ প্রকল্প। এর দৌলতে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা দ্রুত কমছে। নিয়ন্ত্রণে থাকছে ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, সিওপিডি। এক বছর ধরে প্রতিমবাবুর অধীনে চিকিৎসাধীন টালা পার্কের মনোজ সরকার। নিয়মিত সিংহাসন, কপালভাতি করে মনোজবাবু এখন সুস্থ। যোগ-প্রাণায়াম করে ভাল আছেন কিডনি প্রতিস্থাপিত হওয়া রোগীরাও। প্রতিমবাবু জানিয়েছেন, “নিজে যোগ-প্রাণায়াম করে সুফল পেয়েছি। তাই রোগীদেরও প্রেসক্রাইব করছি। আমি চাই সব ডাক্তারবাবুই নিজেরা যোগ-প্রাণায়াম করুন। ও রোগীদের করান।”
হরিয়ানার মেদান্ত হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারির আগে নিয়ম করে যোগ করানো হচ্ছে রোগীদের। বেঙ্গালুরুর নিমহনসে রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্য ফেরাতে প্রাণায়াম করানো হচ্ছে। গুজরাত, বেঙ্গালুরু, কেরলের একাধিক হাসপাতালেও যোগ, আয়ুর্বেদকে যুক্ত করে ইন্টিগ্রেটেড থেরাপি দেওয়া হচ্ছে। ‘নন কমিউনিকেবল’ রোগের ক্ষেত্রে এই মিশ্র থেরাপির প্রয়োগ বাড়ছে।
আসলে শরীর খারাপ হলে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে সমন্বয় নষ্ট হয়। ব্যাঘাত ঘটে প্রাণশক্তির বিস্তারে। যোগ-প্রাণায়াম সিমপ্যাথেটিক ও প্যারা সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে সমতা ফিরিয়ে এনে পুনরায় প্রাণশক্তির বিস্তার ঘটায়। বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মধ্যে সমন্বয় বাড়ায়। যেমন যোগনিদ্রা পেশী, মন এবং স্নায়ুজনিত চাপ কমায়। ফলে উপকৃত হন ডায়াবেটিস, প্রেসার ও অনিদ্রা রোগে আক্রান্তরা। এমনটাই জানানেল যোগ বিশেষজ্ঞ শুভব্রত ভট্টাচার্য। তাঁর পর্যবেক্ষণ, নিশ্বাস-প্রশ্বাস মিলিয়ে আমাদের ফুসফুসের বায়ুধারণ ক্ষমতা ৬ লিটার। কিন্তু আমরা সাধারণভাবে ১ লিটারও নিতে পারি না। নাড়িশোধন প্রাণায়ামের মাধ্যমে ফুসফুস ও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ে। ফলে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শক্তিশালী হয়। যা স্ট্রোক হওয়া রোগীদের রিহ্যাবে দারুণ কার্যকর। ডিমেনশিয়ার মোকাবিলায় ত্রাটক খুব কার্যকরী। ডায়াবেটিস মোকাবিলায় বক্রাসন, অর্ধমৎসেন্দ্রাসন, শঙ্খপ্রক্ষালন।
বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মাসুম পারভেজ করোনার সময়ে প্রাণায়ামের কার্যকারিতা উপলব্ধি করেছেন। জানিয়েছেন, যোগের জাদুতে বহু রোগীই দ্রুত সুস্থ হয়েছেন। পিজি হাসপাতালের সার্জন অধ্যাপক ডা. দীপ্তেন্দ্র সরকার ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের ‘যোগনিদ্রা’-র জন্য উৎসাহিত করেছেন। ডা. দেবাশিস ঘোষ ২০১৬ সাল থেকে নিজেই যোগ থেরাপি দেওয়ার জন্য ক্লিনিক শুরু করেছেন। সেরাটোনিন নিয়ে কাজ করছেন তিনি। খিদিরপুরের বিএনআর হাসপাতালের ডা. সইস্তা তবাসুম সাত-আট বছর ধরে অস্ত্রোপচার হওয়া রোগীদের যোগ-প্রাণায়াম করাচ্ছেন। এঁদের মতো চিকিৎসকদের জন্যই যোগের এই বিশ্বায়ন বা বিশ্বের যোগায়ন। এই কথা স্বীকার করে নিয়েছেন কেন্দ্রীয় আয়ুশকর্তারা।
আসলে করোনা যোগ ও আয়ুর্বেদের কার্যকারিতা নতুন করে চিনিয়েছে। এখন বহু দেশেই, বহু হাসপাতালেই রোগীদের নিয়মিত যোগ প্রাণায়াম করানো হয়। করোনা অতিমারীর সময় মারণ ভাইরাসকে দূরে রাখতে অনেক ডাক্তারবাবু নাসাপান করেছেন। মিশ্র থেরাপির সমর্থনে এ দেশে তৈরি হয়েছে ‘ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেটেড মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’। যা ক্রমশ সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে ডালপালা ছড়াচ্ছে।
এই প্রবণতা নতুন নয়। মডার্ন মেডিসিনের বহু চিকিৎসক যোগ, আয়ুর্বেদ নিয়ে কাজ করেছেন। বিহার স্কুল অফ যোগের স্বামী সত্যানন্দ সরস্বতী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিকিৎসক ছিলেন। তিনি চাকরি ছেড়ে মুঙ্গেরে ‘বিহার স্কুল অফ যোগা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যোগগুরু টি কৃষ্ণমাচারিয়াও চিকিৎসক ছিলেন। ১২৭ বছরের যোগী পদ্মশ্রী স্বামী শিবানন্দ বাবা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী। তিনিও স্বীকার করেছেন, যোগ-প্রাণায়ামই তঁার সুস্থ শরীরের চাবিকাঠি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও সম্প্রতি গোয়ায় ওয়ার্ল্ড আয়ুর্বেদ কংগ্রেস’-এ ইন্টিগ্রেটেড থেরাপির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বলেছেন।
সত্যি, থাইরয়েড, ডায়াবেটিস, সিওপিডি, এমনকী হৃদরোগের ক্ষেত্রেও যোগের মাধ্যমে ‘ডিজিজ রিভার্সাল’ এখন ট্রেন্ডিং। কেউ কুম্ভক থেরাপি করাচ্ছেন। কেউ হঠযোগ করাচ্ছেন। যোগের উপর ৫০০ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। আইআইটি, এইমসের মতো প্রতিষ্ঠান যোগ ও আয়ুর্বেদের কার্যকারিতা প্রমাণে এগিয়ে এসেছে। বেলুড়ে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ‘বিওয়াইএনএস’ কলেজ যোগশ্রী তৈরি হয়েছে। যোগবিজ্ঞানও গুরুকুলের ঘরানা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। পশ্চিমবঙ্গ যোগ ন্যাচারোপ্যাথি কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে এ রাজ্যের ৫৪০টি সুস্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১০৮০ জন যোগ প্রশিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
দেশজুড়েই চলছে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগ প্রশিক্ষক নিয়োগের কাজ। কেজি থেকে ইউজিসি সর্বত্র যোগকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, যোগকে যুক্ত করে সবার জীবনের মান উন্নত করা। ওষুধের মাত্রা কমিয়ে এনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি কমানো। অতএব জীবনে যোগ বাড়ান, ওষুধ কমান।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.