ডা. বিধানচন্দ্র রায় একবার এক ওষুধ নির্মাতার স্ত্রীকে দেখতে গিয়েছিলেন। ওই রোগিনীর অস্ত্রোপচারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছিল। ডা. রায় কিন্তু রোগিনীকে দেখে স্পষ্ট বলে দেন, অস্ত্রোপচারে লাভ হবে না। এর ক্ষতস্থানে জোঁক দিয়ে রক্তমোক্ষণ করাতে হবে।
এমন উদাহরণ অনেক আছে। স্কিন আলসার, ভেনাস আলসার, ভাস্কুলার ডিজিজ, স্কিন ডিজিজে জোঁক বা জলৌকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে। মানবজাতির জন্য আয়ুর্বেদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দান হল জলৌকা। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে জলৌকার ভূমিকা এতখানি যে একে স্বয়ং ভগবান ধন্বন্তরীর হাতে শোভা পেতে দেখা যায়। শল্য শাস্ত্রে একে অনুশস্ত্র হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে যে সমস্ত রোগ কালক্ষয়ে এবং চিকিৎসা বিভ্রমে অসাধ্য হয়ে যায়, সেখানে রক্তমোক্ষণ প্রক্রিয়া করার কথা বলা হয়েছে। রক্তমোক্ষণ অনেক ভাবে করা যায়, জলৌকা তার মধ্যে একটি। শরীরে জলৌকা লাগানোর বিষয়টিকে ‘জলৌকাবচারণ’ বলে।
জলৌকা মূলতঃ দুই প্রকার – সবিষ এবং নির্বিষ। প্রতিটি আবার ছয় প্রকার। এক বিশেষ পদ্ধতিতে জলৌকাকে শোধন করে রোগীর গায়ে বসাতে হয়। যে কোনও ধরনের স্কিন আলসার, ভেনাস আলসার, ভাস্কুলার ডিজিজ, স্কিন ডিজিজে জলৌকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে। নখের রোগ, বিভিন্ন ধরনের ফাঙ্গাল ইনফেকশনে জলৌকা আশু ফলপ্রদ। ছেলেমেয়েদের মুখে ব্রণ এবং দাগ ছোপের সমস্যায়ও জলৌকা ব্যবহার করা হয়।
মেয়েদের সাদা স্রাবের সমস্যায় (ক্রনিক সারভিসাইটিস) জলৌকা ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া গেছে। ফাইলেরিয়া বা শ্লীপদ রোগে জলৌকার ব্যবহার বহুল প্রচলিত।আজকাল ভারতবর্ষের বহু আয়ুর্বেদিক হাসপাতালে চোখের বিভিন্ন রোগে, পক্ষাঘাতে (প্যারালিসিস এবং সেই সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যায়) অবস্থা বুঝে জলৌকা ব্যবহার করা হচ্ছে। ইদানীং কালে প্লাস্টিক সার্জেনরা অপারেশনের পরে সম্যক রক্ত সঞ্চালন চালু করার জন্য জলৌকা ব্যবহার করছেন। এককালে পাশ্চাত্য দেশগুলিতেও জলৌকার বহুল ব্যবহার ছিল। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে চিকিৎসার কারণে জলৌকার বহুল ব্যবহারের কথা পরবর্তী পরিসংখ্যানে পরিষ্কার হয়ে যাবে। ১৮৩০ সালে ফ্রান্স চল্লিশ মিলিয়ন জলৌকা আমদানি করেছিল, তার পরবর্তী দশকে ইংল্যান্ড ছয় মিলিয়ন জলৌকা আমদানি করেছিল কেবল ফ্রান্স থেকে। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে রক্তমোক্ষণ এককালে খুব জনপ্রিয় হলেও বেশি দিন চলেনি নানা কারণে। কিন্তু ভারতবর্ষে এর ব্যবহার প্রায় পাঁচ হাজার বছরের। সামান্য এই প্রাণীর সাহায্যে মানবজাতির অসামান্য উপকার করে চলেছেন চিকিৎসকেরা। জলৌকা অবচারণ আরও বেশি জনপ্রিয় হলে আখেরে লাভ মানুষেরই।
লেখক: ডা. পুলককান্তি কর
রিডার, পঞ্চকর্ম বিভাগ, জেবি রায়
আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল কলেজ অ্য়ান্ড হাসপাতাল
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.