ছবি: সংগৃহীত
মনঃসংযোগ বা একাগ্রতা জীবনের সাফল্যের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। তবে এটা সর্বক্ষেত্রে ধরে রাখা বেশ কঠিন। যাঁরা পারেন তাঁরাই কিন্তু সফল হন। কীভাবে মনঃসংযোগকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে আয়ত্তে আনা সম্ভব সেটাই বিশ্লেষণ করলেন সল্টলেক মাইন্ডসেট-এর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবাঞ্জন পান। প্রতিবেদনটি লিখেছেন জিনিয়া সরকার।
খেলতে খেলতে খেলোয়াড় হয়, লিখতে লিখতে লেখক। অতএব মনঃসংযোগ করতে করতেই মিলতে পারে অখণ্ড মনোনিবেশের ক্ষমতা। আবার কীভাবে ভেঙে যায় মনঃসংযোগ – তাও জানতে হয়। এই মনঃসংযোগ ভাঙার জায়গাটা যত কম হবে, ততই দৃঢ় ভাবে গড়ে উঠবে মনোযোগের ক্ষমতা।
কীভাবে আমরা মনোনিবেশ করি?
আমাদের ব্রেনে চারটি স্তরে মনোযোগ গঠিত হয়। এই চারটি স্তরের প্রথমটি হল — মাইন্ড ওয়ান্ডারিং মোড বা ম্যাঙ্কি মাইন্ড। এই অবস্থায় দ্রুত এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় মন সরতে থাকে। যে মন এখন রয়েছে কলকাতার সায়েন্স সিটিতে পরক্ষণেই চলে যেতে পারে আমেরিকায়! তার পরই আবার রোনাল্ডো খেলা কিংবা দুপুরের শুক্তোয়।
দ্বিতীয়টি, সেন্ট্রাল এগজিকিউটিভ নেটওয়ার্ক বা ফোকাস নেটওয়ার্ক। যখন কেউ কোনও কিছু লেখালিখি বা কোনও বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন, শিশুরা যখন পড়াশোনা করে তখনই প্রয়োজন হয় এই নেটওয়ার্কের। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো, গভীর মনোযোগের সময় যে দুটি স্নায়ুযৌগের সাহায্য লাগে সেগুলি হল নরএপিনেফ্রিন এবং ডোপামিন নামে দুই স্নায়ুযৌগ বা হরমোন।
মনোনিবেশে সাহায্যকারী তৃতীয় মোডের নাম অ্যাটেনশনাল ফিল্টার। এক মনে বই পড়া বা কোনও কাজ করার সময় মনটাকে কাজের মধ্যে ধরে রাখার কর্মটি করে অ্যাটেনশনাল ফিল্টার।
এর পর অবশ্যই অ্যাটেনশনাল সুইচ মোডটির কথা বলতে হবে। মস্তিষ্কের এই অংশ বিপদে পড়লে পালানো পথ বাতলে দেয়। এবং মনঃসংযোগ বা কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির থাকার জন্য মস্তিষ্কের এই চারটি অংশের কাজ ঠিক রাখা দরকার।
উৎপাতের উৎস বাদ দিন
সারাদিনে ফোনে কথা বলা ছাড়া স্মার্টফোনের স্ক্রিনে বেশিক্ষণ চোখ আটকে রাখবেন না। বিনা কারণে স্ক্রল করা এখনই বন্ধ করুন। যতখানি সম্ভব এড়িয়ে চলুন সোশাল মিডিয়ার ব্যবহার। সহজ কথায় স্মার্টফোন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে দিন। কেন বলা হচ্ছে এমন কথা? সাম্প্রতিক এক তথ্য অনুসারে গড় আমেরিকানরা সারাদিনের মধ্যে ১২ ঘণ্টাই কাটান নানাভাবে ডিজিটাল মিডিয়ায়। তা হলে এদেশের মানুষ? তাঁদের তো সচেতনতা আরও কম।
ব্রেনকে কলুর বলদের মতো খাটাচ্ছি রিল দেখে, রিল বানিয়ে। এই নেশায় বুঁদ হয়ে ব্রেনকে খাটাতে হচ্ছে বেশি, ফলে অতিরিক্ত খাবার জোগাতে হচ্ছে বেশি। ফলে খাবারও খেতে হচ্ছেও বেশি। কারণ ব্রেনকে গ্লুকোজের জোগানও দিতে হয় অ্যাকটিভ রাখতে। এভাবে সারাদিন চললে একসময় ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হওয়াও আশ্চর্য নয়। অতএব মনোনিবেশের প্রথম শর্তই হল মানসিক বিক্ষেপ ঘটায় এমন সমস্যাগুলিকে দূরে সরিয়ে রাখা।
শরীরচর্চা
প্রতিদিন আধঘণ্টা শরীরচর্চা করুন। দেখা গিয়েছে দৈহিক সক্রিয়তার মাধ্যমে শরীরে যত রক্ত সঞ্চালন বাড়বে তত বেশি করে ব্রেনে পৌঁছবে রক্ত। একইসঙ্গে মস্তিষ্কে বাড়বে ব্রেন ডিরাইভড নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টরের ক্ষরণ। ব্রেনের এই সক্রিয়তা বাড়াতে ও নতুন নিউরোন তৈরির ক্ষেত্রে এই উপাদানটি জরুরি।
মনোযোগ বাড়াতে মাইন্ডফুলনেস চর্চা
মনের নানা অবস্থা নিয়ে গবেষণা বলছে, অতীত এবং অজানা ভবিষ্যৎ নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা আমাদের মনোনিবেশে বাধা দেয়। অতৃপ্তি, অপ্রাপ্তি, শঙ্কা মিলে তৈরি হয় স্ট্রেস। এই উদ্বেগ থেকে বেরোতে পারলেই, মস্তিষ্ককে শান্ত করতে পারলেই ব্রেনের যে অংশগুলি যুক্তি দিয়ে ভাবতে পারে বা স্মৃতি ধরে রাখতে পারে সেগুলি সজাগ হয়ে ওঠে। ফলে ঠান্ডা হয়ে ভাবতে পারা যায়। বেরিয়ে আসে যে কোনও সমস্যার সমাধানসূত্র।
মনকে শান্ত আর শীতল রাখার জন্য খুব সুন্দর একটি ব্যায়াম রয়েছে। এই ব্যায়ামের নাম মাইন্ডফুলনেস এক্সারসাইজ। সহজভাবে বললে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সচেতনভাবে লক্ষ্য করাই হল মাইন্ডফুলনেস এক্সারসাইজ! তা কেমন? ধরুন আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। সামনের গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ল। মাইন্ডফুলনেস এক্সারসাইজ বলছে, এইভাবে বিষয়টা দেখুন। ওই গাছের পাতাটির আকার কেমন? কেমন ছিল রং? কিংবা যে বাতাস উড়িয়ে দিল আপনার চুল, তা কি ছিল শীতল? আবার এই যে টেবিল থেকে বোতলের জল খেলেন, সেই বোতলের রং কেমন। কেমন ছিল তার বোতলের মুখের রং। বোতলের তলায় জমে ছিল কি বুদ্বুদ। এই পদ্ধতি একধরনের নিরন্তর অভ্যাসের মতো। অর্থাৎ যেকোনও বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করা।
এভাবে চারপাশের বস্তুগুলিকে এমন খুঁটিয়ে দেখে লাভ কী? কারণ অতীত নিয়ে ভাবনা ডেকে আনে অতৃপ্তি আর অপ্রাপ্তির অনুভব। অন্যদিকে অজানা ভবিষ্যৎ তৈরি করে তীব্র আশঙ্কা। বরং আমরা অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করি বর্তমানে। ফ্যান ঘুরছে, হাওয়া ঘরটি দুলছে— এই তাৎক্ষণিক মুহূর্তগুলির দিকে নজর দেওয়াই আমাদের মধ্যে নিরাপত্তার বোধ তৈরি করে। তবে সবসময় মাইন্ডফুলনেস-এর চর্চা হয়তো আমরা করতে পারব না। তাই প্রতিদিন ব্যস্ততার মধ্যেও একটা সময় বের করতে হবে মাইন্ডফুলনেস-এর চর্চার জন্য। কোনও সময় বের করতে না পারলে খাবার খাওয়ার সময়টিকেই ব্যবহার করুন।
খাবার খেতে খেতে মাইন্ডফুলনেস চর্চা কীভাবে?
প্রথমে দেখুন খাবার খাওয়ার প্লেটের রংটি কেমন। পাতে পড়ল কী কী খাবার? ডাল, ভাত, তরকারি, মাছ? কোন ডাল, কোন মাছ? জিভের স্বাদকোরকগুলির সাহায্যে বোঝার চেষ্টা করুন ঠিক কোন উপাদান ও মশলা ব্যবহার করা হয়েছে রান্নায়। এভাবে মাইন্ডফুলনেস-এর চর্চার সময়েও মন ফের অতীতে বা ভবিষ্যতের চিন্তায় ডুবে যেতে পারে। সেটা বুঝতে পারলে নিজেকে দোষারোপ করবেন না। কারণ আপনার যে চিত্তবিক্ষেপ ঘটেছে তা বুঝতে পারলেই জানবেন আপনি সাফল্যের পথে এগিয়ে গিয়েছেন অনেকখানি। কারণ এই বিক্ষেপ যে ঘটে তা আপনি আগে ধরতেও পারতেন না। অর্থাৎ আপনি ক্রমশ সচেতন হচ্ছেন। এবার পালা মনকে নিজের পরিকল্পনা অনুসারে বাঁধা। পুনরায় মনোনিবেশ করুন খাদ্যের স্বাদ ও গন্ধে। জানবেন এই অভ্যাসই একসময় আপনাকে শত বিক্ষেপের উপাদান থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্যে রাখবে স্থির! খাবার টেবিল থেকে কাজের টেবিলে সর্বক্ষেত্রেই সম্ভব হবে অখণ্ড মনোযোগ ধরে রাখা।
জরুরি টিপস
প্রাতঃকৃত্য সারার সময় সঙ্গে করে স্মার্টফোনটি নিয়ে যাওয়া বন্ধ করুন। বন্ধ করুন খাবার খেতে বসার সময় মোবাইল ফোনের ব্যবহার। এই কাজ নির্দেশ করে আপনি বড় বেশি চঞ্চল হয়ে পড়েছেন। সুস্থির ভাবনা আপনার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তাছাড়া রেস্টরুমে স্মার্টফোন নিয়ে যাওয়ার অর্থ প্রচুর ব্যাকটিরিয়া নিয়ে ঘরে ফেরা। এই ব্যাকটিরিয়া খাবার খাওয়ার সময় পেটে ঢুকলে ভয়ঙ্কর অসুস্থ হওয়া সম্ভাবনাও থাকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.