ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: যাঁদের হাতে জীবনের ভার, তাঁরাই যদি অসুস্থ হন? দীর্ঘসময় মারাত্মক সংক্রমক ব্যাধির সঙ্গে লড়াইয়ের জেরে মানসিক ক্লান্তি ভর করে? একবছরের বেশি সময় করোনা (Coronavirus) হাসপাতালে রোগী পরিচর্যার কাজে যুক্ত চিকিৎসক-নার্সদের একাংশের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এমনই চিন্তায় চিকিৎসকমহল। জানা যাচ্ছে, কাজের চাপে কোভিড হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সের একটি বড় অংশের ওজন কমেছে। অনিয়মিত ঘুম ও বিশ্রামের অভাবে অল্পেতেই ধৈর্য হারিয়েছেন। সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কেউ কাউন্সেলিং করছেন। কেউ চিকিৎসকের কাছে গিয়েছেন।
গতবছরের মার্চে রাজ্যে থাবা বসায় করোনা ভাইরাস। মাত্র তিনমাসের ব্যবধানে অতিমারীর চেহারা নেয়। মারাত্মক সংক্রমণ রুখতে এমআর বাঙুর বা বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালকে করোনা হাসপাতাল হিসাবে চিহ্নিত করে দেয় স্বাস্থ্যদপ্তর। শুরু হয় এক অসম লড়াই। চিকিৎসক বা নার্সের সংখ্যা না বাড়লেও রোগী কিন্তু বেড়েছে। ফলে রোগীর প্রাণ বাঁচাতে টানা ১০-১২ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় পিপিই, মাস্ক পরে কোভিড ওয়ার্ডে কাজ করেছেন চিকিৎসকরা-নার্সরা। ক্যান্টিন থেকে খাবার পাঠালেও সেই খাবার পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে। এমনও হয়েছে সহকর্মী অসুস্থ হওয়ায় রোগীর প্রাণ বাঁচাতে কয়েকঘণ্টার ব্যবধানে ফের কোভিড ওয়ার্ডে ঢুকে পড়তে হয়েছে। এমন দৃশ্য প্রায় রোজই দেখা গিয়েছে বাঙুর বা বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে। বাঙুর হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডের নার্সিং স্টাফ তানিয়া পরভিন বা পৌলমী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওজন কমেছে অন্তত ১০-১২ কেজি। একই অবস্থা হাসপাতালের চিকিৎসক মানস নাথের।
এক বছরে তানিয়া পরভিনের ওজন ৭০ থেকে ৬০ কেজি হয়েছে। তাতে অবশ্য খুব একটা মাথাব্যথা নেই তানিয়া বা পৌলমীর। দু’জনেই একযোগে বলেছেন, “কোভিড ওয়ার্ডের ভেন্টিলেশনে একের পর এক রোগী মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। অসহ্য যন্ত্রণায় শরীর থরথর করে কাঁপছে। আর আমরা মনিটরে নজর রেখে চলেছি। দুপুর গড়িয়ে কখন মাঝরাত হয়েছে বুঝতেই পারিনি। মনে হয়নি খাওয়ার কথা।”
আবার পৌলমী জানিয়েছেন, “অসম লড়াইয়ের পর মৃত্যু যখন হার মানে। রোগী সুস্থ হন। পরিজনের সঙ্গে ফিরে যান বাড়িতে। সেই আনন্দ সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।”
দীর্ঘ সময় একই করোনা ওয়ার্ডে কাজ করার জেরে চিকিৎসকদের মধ্যে মানসিক সমস্যাও দেখা দিয়েছে। এমন সমস্যা নিয়ে কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রিতে করোনা আবহে অন্তত তিনজন চিকিৎসক কাউন্সেলিং করিয়েছেন। সংস্থার অধিকর্তা ডা. প্রদীপ সাহার কথায়, “এই ধরনের সমস্যাকে বলে, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার। তিন জুনিয়র ডাক্তার এসেছিলেন। কোভিড ওয়ার্ডে টানা কাজের চাপ, এবং করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। করোনা সংক্রমণ এড়াতে বারবার হাত পরিস্কার করেন। দরজা বন্ধ হয়েছে কি না তা বারবার যাচাই করেন। রোগীরা মনে করেন তাঁদের পেশার জন্যই পরিবারে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। টানা তিনমাস কাউন্সেলিংয়ের পর সুস্থ হয়েছেন ওই তিন চিকিৎসক।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.