ছবি: প্রতীকী
বর্ষাকাল মানেই সাপের উপদ্রব। প্রায় রোজই খবরে সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা শোনা যাচ্ছে। ভিজে মাঠঘাটে, বনবাদাড়ে সর্বত্র তেনাদের হিলহিলে উপস্থিতি। পান থেকে চুন খসলেই ব্যস। এক ছোবলেই প্রতিপক্ষ ছবি। কিন্তু কামড়ানোর কিছুক্ষণের মধ্যে সঠিক চিকিৎসা দ্বারা রোগীকে প্রাণে বাঁচানো সম্ভব। দুঃখজনক হল, সচেতনতা কম ও অজ্ঞতার কারণে আজও এ রাজ্যে বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। সর্পদংশনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদার ও যুক্তিবাদী সমিতির সৌম্য সেনগুপ্তের সঙ্গে কথা বলে লিখলেন গৌতম ব্রহ্ম।
কালাচ, চন্দ্রবোড়া, কেউটে, গোখরো। বর্ষায় এই মহা-চারের ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে গ্রামবাংলা। দেশের অন্যত্রও বর্ষায় এই চার প্রজাতির নাগ-নাগিনের উপদ্রব। এদের থেকেও বিষাক্ত সাপ আছে। শঙ্খচুড়, শাঁখামুটি। এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ইয়েলো বেলি সি স্নেকের আতঙ্ক। দিঘায় সমুদ্র সৈকতে সম্প্রতি এই সাপ দেখা গিয়েছে, যা মূলত আরব সাগরের বাসিন্দা। এই সাপ এই মহা-চারের থেকেও ভয়ংকর। প্রথমত AVS কাজ করবে না। তার উপর বিষের তীব্রতা এত বেশি যে হাসপাতালে নেওয়ারও সময় পাওয়া যায় না।
জেলেদের জালে মাঝেমধ্যেই ধরা দেয় এই মূর্তিমান মৃত্যুদূত। মাঝসমুদ্রে গিয়ে অনেকেই এর দংশনে প্রাণ হারান। কিন্তু সাধারণ মানুষের এই নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের চিন্তা মহা-চারকে নিয়ে। মহা-চারের ছোবলে ফি বছর বহু মৃত্যু হয়। দেশের অন্যত্রও এক ছবি। সরকারি হিসাবে ভারতে ফি বছর গড়ে ৫০ হাজার মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। কিন্তু বেসরকারি মতে সংখ্যাটা লক্ষাধিক।
কালাচের কামড় তো বেশিরভাগ মানুষ বুঝতেই পারেন না। বাকি ক্ষেত্রে বুঝতে পারলেও ওঝা, গুনিন করে সময় নষ্ট হওয়ায় রোগীকে বাঁচানো মুশকিল হয়। অথচ এমনটা হওয়ার কথাই নয়। সর্প দংশনে একটা প্রাণও যাওয়ার কথা নয়। কারণ সর্পাঘাত মোকাবিলায় ব্রহ্মাস্ত্র AVS আমাদের হাতে আছে। ব্লক প্রাইমারি স্তরের হাসপাতালেও এই ইনজেকশন মজুত। দংশনের ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ মিলিলিটার রোগীর শরীরে প্রবেশ করাতে পারলেই ব্যস। বিষমোচন হয়ে যাবে। রক্ষা পাবে সর্পদ্রষ্ট।
অস্ট্রেলিয়াতে ভারতের থেকে অনেক বেশি বিষাক্ত সাপ আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাঁচ বছরে চার-পাঁচটির বেশি সর্পদংশনে মৃত্যুর নজির নেই। আর আমাদের গ্রামবাংলায় কুসংস্কারের কারণে ফি-বছর কত মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার থেকে অনেক বেশি প্রাণ কাড়লেও সর্পদংশনের বিষয় নিয়ে সরকারি স্তরে তেমন প্রচার নেই। কয়েকজন ডাক্তার, শিক্ষক ও যুক্তিবাদী সমিতির মানুষ শুধু এই নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সচেতন করার কাজ করে চলেছে।
এটা দুঃখের হলেও সত্যি যে, MBBS সিলেবাসে সাপের কামড়ের চিকিৎসা বিষয়টি ভীষণভাবে অবহেলিত। তার কারণ হয়তো এটি একটি ‘অবহেলিত গ্রামীণ সমস্যা’। তাই আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে ডাক্তার, নার্সদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির। ‘স্নেক বাইট ইন্টারেস্ট গ্রুপ’ নামে একটি গ্রুপ খোলা হয়েছে। যেখানে ভারতের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাঁদের মূল্যবান বক্তব্য বিনিময় করছেন। সর্পদংশনের চিকিৎসায় একটি জাতীয় স্তরের নীতিমালা তৈরি হওয়ার পথে। পশ্চিমবঙ্গের অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে বিষয়টি এসেছে।
বাংলার মহা-চার
১) গোখরো (ফণাধর নার্ভবিষ)
২) কেউটে (ফণাধর নার্ভবিষ)
৩) চন্দ্রবোড়া (রক্তকণিকা ধ্বংসকারী)
৪) কালাচ (ফণাহীন নার্ভবিষ)
কামড় এড়াতে –
বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন।
রাতে অবশ্যই বিছানা ঝেড়ে মশারি টাঙিয়ে শোবেন। (মেঝেতে ঘুমালে মশারি বাধ্যতামূলক)
অন্ধকারে হাঁটাচলা করবেন না, একান্তই বাধ্য হলে হাতে লাঠি নিয়ে রাস্তা ঠুকে
চলুন, হাততালি দিয়ে লাভ নেই, কারণ সাপের কান নেই।
জুতো পরার আগে তা ঝেড়ে নিন।
মাটির বাড়িতে কোনও ইঁদুর গর্ত থাকলে তা আজই বুজিয়ে ফেলুন।
সাপের কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসা
Do R_I_G_H_T
R- Reassurance
রোগীকে আশ্বস্ত করুন। কারণ রোগী খুবই আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। আতঙ্কও মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। রোগীকে বোঝান, সাপের কামড়ে আক্রান্ত বহু মানুষ চিকিৎসায় বেঁচে উঠেছেন, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।
I – Immobilization
যত কম নড়াচড়া হবে তত কম হারে বিষ সারা শরীরে ছড়াবে। স্কেল বা বাঁশের টুকরো সহ হাতে/ পায়ে (যে অংশে কামড়াবে) কাপড় দিয়ে হাল্কা করে বেঁধে দিন। হাত বা পা (কামড়ের নিকটতম স্থান) যাতে তিনি ভাঁজ করতে না পারেন তাই এই ব্যবস্থা ।
GH – Go To Hospital
ফোন করে জেনে নিন আপনার নিকটতম যে হাসপাতালে
A.V.S ,
নিওস্টিগমিন, অ্যাট্রোপিন এবং অ্যাড্রিনালিন আছে সেই হাসপাতালে চলুন। মাথায় রাখবেন সাপের কামড়ের সম্পূর্ণ চিকিৎসা একটি ব্লক প্রাইমারি হেলথ সেন্টারেই সম্ভব। সম্ভব হলে রোগীকে মোটর সাইকেলের মাঝে বসিয়ে রোগীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলুন। জেনে রাখবেন এখানে সময়ের ভূমিকা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
T- Tell Doctor for Treatment
হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসককে সাপের কামড়ের চিকিৎসা করতে বলুন। কথা বলতে গিয়ে রোগীর কথার মধ্যে কোনও অসঙ্গতি (যেমন কথা জড়িয়ে আসা, নাকি সুরে কথা বলা খেয়াল করলে তা যথাযথ, যেমন কতক্ষণ আগে শুরু হল) তা চিকিৎসককে জানান।
RULE OF 100
সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে ১০০ মিলিলিটার (১০ ভায়াল) AVS শরীরে প্রবেশ করলে রোগীর বেঁচে যাবার সম্ভাবনা ১০০%।
হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। কোন পথে চলবে চিকিৎসা? ডাক্তার কীভাবে বোঝেন সাপের কামড়?
20 WBCT
(20 Minute Whole Blood Clotting Test)
এই পরীক্ষার দ্বারা রোগীর রক্ত তঞ্চনের কোনও ব্যাঘাত ঘটেছে কি না তা জানা যায়।
রোগীর শরীর থেকে ২ মিলিলিটার রক্ত নিয়ে নতুন কাচের টেস্ট টিউবে দাঁড় করানো অবস্থায় ঠিক ২০ মিনিট রেখে টেস্টটিউবটিকে কাত করে দেখতে হবে রক্ত জমাট বেঁধেছে কি না। রক্ত জমাট না বাঁধলে অবশ্যই চন্দ্রবোড়ার কামড়।
চন্দ্রবোড়া (হেমাটক্সিক) ছাড়া সমস্ত সাপের কামড় নিশ্চিত হওয়া যায় কেবলমাত্র রোগীর লক্ষণ দেখে-
বিষক্রিয়ার লক্ষণ-
দু’ চোখের পাতা পড়ে আসা Bilateral Ptosis (নিউরোটক্সিক সাপের ক্ষেত্রে কামড়ের মূল লক্ষণ)
কামড়ের স্থানে অসম্ভব জ্বালা-যন্ত্রণা (ফণাধর সাপের ক্ষেত্রে)
ক্রমবর্ধমান ফোলা
শরীরের নানা স্থান থেকে রক্ত বেরিয়ে আসবে (চন্দ্রবোড়ার ক্ষেত্রে)
ঢোক গিলতে অসুবিধে
ঝাপসা দেখা
জিভ জড়িয়ে যাওয়া
ঝিমিয়ে পড়া
চিকিৎসায় দেরি হলে শ্বাসকষ্ট এবং শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু।
এশিয়ার বিষাক্ততম সাপ কালাচের কামড়ে কোনও জ্বালা-যন্ত্রণা থাকে না, দংশন স্থানে কোনও চিহ্ন পাওয়া প্রায় যায়ই না। পেটে ব্যথা, গাঁটে গাঁটে ব্যথা, খিঁচুনি কিংবা শুধুমাত্র দুর্বলতা অনুভব করার লক্ষণের সঙ্গে দু’চোখের পাতা পড়ে আসা নিশ্চিত কালাচের কামড়ের লক্ষণ।
কোনও অবস্থায় রোগীকে রেফার করতে হলে ১০ ভায়াল AVS, নিওস্টিগমিন এবং অ্যাট্রোপিন না দিয়ে রেফার করা যাবে না।
AVS দিলে ৭০% ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (শ্বাসকষ্ট, শরীরে আমবাতের মতো দেখতে পাওয়া ইত্যাদি) ঘটে যাকে সাময়িক স্যালাইন বন্ধ করে ইনজেকশন সিরিঞ্জে ধরে রাখা ০.৫ মিলি অ্যাড্রিনালিন দিয়ে মোকাবিলা সম্ভব। চন্দ্রবোড়ার কামড়ে চিকিৎসায় দেরি হলেই কেবল ডায়ালেসিস লাগে।
তবু জেনে রাখা ভাল, সাপের কামড়ে কোনও রোগীর মৃত্যু ঘটলে মৃত ব্যক্তির বাড়ির লোক এককালীন ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পান। সেক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার ‘মৃত্যুর কারণ যে সাপের কামড়’ এই মর্মে শংসাপত্র প্রদান করবেন। কারণ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এই শংসাপত্রই গ্রহণীয় নথি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.