ছবি: প্রতীকী
ক্যানসার নয়। বাঙালির সবচেয়ে বড় দুশমন এখন ডায়াবেটিস। সবচেয়ে বেশি এই অসুখে ভুগেই প্রাণ হারাচ্ছেন বাংলার মানুষ। ভারতে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭.২ কোটি। ভুগছেন ১০% বাঙালি। ঘাতক মধুমেহ শরীরে নিঃশব্দে মাথাচাড়া দেওয়ার আগেই পিষে ফেলুন। খাবার খান মেপে, চাপকে দিন চেপে। লিখছেন গাইনোকলজিস্ট ডা. এস এম রহমান।
জয়নগরের মল্লিকা রায়ের (নাম পরিবর্তিত) পরপর পাঁচবার মিসক্যারেজ হয়। প্রতিবারই কনসিভ করার সময় তাঁর ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকত। বারবার এমন দুর্ঘটনায় মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে আমার কাছে যখন এলেন তখনও সুগার লেভেল মাত্রাছাড়া। এই অবস্থা থেকেও কিন্তু মা হওয়া সম্ভব। সঠিক ওষুধ, প্রয়োজনমতো ডোজের ইনসুলিন আর ডায়েট- এই তিন হাতিয়ারের সাহায্যে মাত্র তিন-চার মাসের মধ্যে ডায়াবেটিস একদম কন্ট্রোলে নিয়ে আসেন বছর ৩৪-এর মল্লিকা। আর তারপরেই প্রেগন্যান্সিও আসায় কোনও অসুবিধা হয়নি।
ডায়াবেটিস থাকলে প্রেগন্যান্সিতে বারবার মিসক্যারেজ হতেই পারে। হাল ছেড়ে দেওয়ার কিছু নেই। অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড সুগারও এখন নতুন কিছু ওষুধের সাহায্যে কয়েক মাসের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তাই পরিবার পরিকল্পনার সময়ই ডায়াবেটিস পুরোপুরি কন্ট্রোলে আনার কথা ভাবতে হবে। মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে বারবার গর্ভপাতের ঝুঁকি যেমন থাকে তেমনই শিশুর গঠনগত সমস্যাও হয়। বিশেষ করে শিরদাঁড়া, হার্টের গঠনে সমস্যা হতে পারে।
চিকিৎসার প্রথম ধাপ:
হাই ব্লাড সুগারের রোগীরা যখন প্রেগন্যান্সি চান তখন তাঁদের প্রথমেই আমরা ব্লাড সুগার কমানোর জন্য ডায়েটিশিয়ানের কাছে পাঠাই এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য এন্ডোক্রিনোলজিস্টের কাছে পাঠাই। এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ও গাইনোকলজিস্ট দু’জনে মিলে রোগীর শারীরিক অবস্থা দেখে এবং তা নিয়ে আলোচনা করে যদি ওষুধ ঠিক করেন তাহলে এই চিকিৎসায় সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যায়। ডায়াবেটিসের সমস্যা কাটিয়ে মা হতে চাইলে স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞর পাশাপাশি এন্ডোক্রিনোলজিস্ট এবং ডায়াটিশিয়ানের ভূমিকা সমান গুরুত্বপূর্ণ। এবং এই তিনজন একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করে যদি চিকিৎসা করেন তাহলে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে এনে মা হওয়া মোটেই কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়।
ওষুধ না কি ইনসুলিন?
আগে মনে করা হত ডায়াবেটিস রোগী গর্ভধারণ করতে চাইলে ইনসুলিন নিতেই হবে। কিন্তু অনেকেই ভাবতেন, ইনসুলিন নিলে সারা জীবন তা নিয়ে যেতে হবে, আর ওরাল ওষুধে ফেরা যাবে না। কিন্তু তা মোটেই সত্যি নয়। প্রেগন্যান্সির পরে ফের ওরাল মেডিসিনে ফেরা যায়। বরং ইনসুলিনই গর্ভস্থ শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। কারণ ইনসুলিনের মাধ্যমে আসা ওষুধের প্রভাব প্ল্যাজেন্টা পেরিয়ে শিশুর কাছে পৌঁছয় না। কিন্তু সাধারণ মানুষকে বুঝিয়েও প্রেগন্যান্সির ক’মাস ইনসুলিন ব্যবহারের জন্য রাজি করানো বেশ কঠিন হত। সেই কারণেই এখন এই ভাবনায় বদল এসেছে। রোগীর ব্লাড সুগারের ধরন, প্রবণতা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কোনও অসুখ আছে কি না তা দেখে নিয়ে ঠিক করা হয় কোন ক্যাটেগরির ওষুধ দেওয়া হবে। বেশ কিছু ওষুধ ব্যবহার করলে ইনসুলিনের প্রয়োজন হয় না। কিছু ক্যাটেগরির ওষুধ গর্ভস্থ শিশুর জন্য সবচেয়ে ভাল। আবার কিছু ক্ষেত্রে ওরাল মেডিসিন এবং অল্প ইনসুলিন প্রয়োগেই সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট মেলে। কীভাবে চিকিৎসা হবে সেটা পুরোটাই এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ও গাইনোকলজিস্ট দু’জনে মিলে ঠিক করবেন।
কিছু ক্যাটেগরির ওষুধ সাধারণত কেমোথেরাপি চলছে এমন মা যদি কনসিভ করেন তবে তাঁকে দেওয়া হয়। এই ধরনের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিন্তু শিশুর উপর পড়ে। গ্লাইবিউরাইড বা মেটফরমিন জাতীয় ওষুধ খেলে মায়ের ডায়াবেটিস যেমন নিয়ন্ত্রণে থাকে তেমনই গর্ভস্থ শিশুর কোনও ক্ষতি হয় না। যাঁদের এই ওষুধগুলিতে ব্লাড সুগার ভাল কন্ট্রোল হয় তাঁদের এই ওষুধ খেয়ে যেতে বলা হয় এবং কনসিভ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবু জেনে রাখা দরকার, মা এই ধরনের ওষুধ খেলে সন্তানের জন্মের পর প্রথম ৪৮ ঘণ্টা হাইপোগ্লাইসেমিয়া অর্থাৎ ব্লাড সুগার বেশি থাকতে পারে, খিঁচুনি হতে পারে। ক্যালশিয়ামের মাত্রার গন্ডগোল হতে পারে। বাচ্চা স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়। তাই ডায়াবেটিক মায়েদের প্রসবের সময় হাসপাতালে নিওন্যাটোলজিস্টের উপস্থিতি ভীষণ জরুরি। এঁরা সদ্যোজাতর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করে তাকে স্বাভাবিক করে তোলেন।
ডায়েট ভীষণ জরুরি:
ব্লাড সুগার কমানোর জন্য এই স্টেজে সঠিক ডায়েট ও ক্যালোরি মেনে খাওয়া-দাওয়া ভীষণ জরুরি। অনেক মহিলা আছেন যাঁদের ওষুধ দিতে লাগেনি, শুধু ডায়েট মেনে ও শরীরচর্চা করেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এনে মা হতে পেরেছেন। ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শমতো কম ফ্যাটযুক্ত খাবার খান। প্রচুর সবুজ-শাকসবজি খান। দৈনন্দিন আহারে ৫০-৬০% কার্বহাইড্রেট থাকবে। ১০% ফ্যাটি অ্যাসিড থাকবে। প্রধান আহার তিনবার করুন। আর এই তিন আহারের মাঝে একবার করে অর্থাৎ দিনে মোট তিনবার অল্প করে কিছু খেয়ে নিন। একসঙ্গে অনেকটা খাবেন না। তাতে সুগার বেড়ে যায়। আলু, মাটির নিচের জিনিস খাওয়া পুরো বন্ধ করার দরকার নেই। ক্যালোরি মেপে খুব অল্প খাওয়া যায়।
HbA1c নর্মাল হলেই:
ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের সময় সাধারণ ব্লাড সুগার টেস্টের পাশাপাশি হিমোগ্লোবিন HbA1c টেস্ট করিয়ে দেখে নিতে হবে। ওই রিপোর্টের মাত্রা যেন ৬.৫-এর নিচে থাকে। এর বেশি থাকলে তখনই সন্তানধারণের চিন্তা করবেন না। গাইনোকলজিস্টের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে আগে সব টেস্টের রিপোর্ট নর্মাল করে তবেই মা হওয়ার কথা ভাবতে হবে। HbA1c টেস্টে যাঁদের মাত্রা ৭-৮ তাঁদের প্রেগন্যান্সিতে রিস্ক থাকে। ৮-১০ হলে আরও বেশি ঝুঁকি। গর্ভধারণের পর অ্যানোম্যালি স্ক্যান ও ফিটাল ইকো করানো ভীষণ জরুরি। শিশুর ত্রুটি থাকলে তখনই ধরা পড়ে।
ডায়াবেটিসে আইভিএফ:
ডায়াবেটিস মা হওয়ার পথে বাধা হয়ে উঠলেই যে আইভিএফের মতো পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে এমন নয়। সাধারণত যে সব মহিলার স্ত্রী-রোগ ও ডায়াবেটিস দুই-ই থাকে তাঁরা আইভিএফ করাতে পারেন। তবে আইভিএফ চিকিৎসায় গর্ভে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের আগে দেখে নেওয়া হয়, রোগীর ব্লাড সুগার লেভেল নর্মাল আছে কি না। ফাস্টিং ১২৬-এর নিচে ও পিপি ১৪০-এর কাছাকাছি থাকলেও আইভিএফে অনুমতি দিই। এক্ষেত্রেও HbA1c টেস্ট করে দেখে নেওয়া হয়। সাধারণত ডায়াবেটিস কন্ট্রোল করে আইভিএফ ট্রিটমেন্ট শুরু করতে ২-৩ মাস লাগে। যাঁরা ঠিকমতো কন্ট্রোল করতে পারেন না, তাঁদের চিকিৎসা শুরুর পর ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করতে ১০-১১ মাসও লাগতে পারে।
আইভিএফ চিকিৎসায় প্রথম চেষ্টাতেই ভ্রূণ সফলভাবে প্রতিস্থাপিত হয়ে গর্ভধারণ সম্ভব কি না তা নির্ভর করে ভ্রূণের কোয়ালিটির উপর। এর উপর ডায়াবেটিস কোনও প্রভাব ফেলে না।
পৌষালী দে কুণ্ডু
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.