গৌতম ব্রহ্ম: পুলিশের জালে যতদিনে ধরা পড়ল, চোর তার আগেই বিস্তর অপকর্ম সেরে ফেলেছে। গেরস্তের ক্ষতি যা করার, করে ফেলেছে অনেকটাই।
নোভেল করোনা ভাইরাসও যেন প্রায় একইরকম দুর্বৃত্ত। উপসর্গ হয়ে ধরা পড়াটা পরের ব্যাপার। সংক্রমণের ময়দানে তার ঠিক ১৮ ঘণ্টা আগে সে সবচেয়ে বেশি দাদাগিরি চালায়। অর্থাৎ, একজন কোভিড পজিটিভ ব্যক্তি হাঁচি-কাশি শুরুর আগেই প্রচুর মানুষকে সংক্রমিত করে ফেলতে পারেন। প্রায় সমসংখ্যাকে সংক্রমিত করেন পরবর্তী ২১ দিনে। সে কারণেই করোনা এত ভয়ংকর।
সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকায় ভাইরাসের এই ‘ইনকিউবেশন পর্ব’ সম্পর্কে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগে রোগী বা তার আশপাশের লোকজনের সতর্ক হওয়ার কোনও উপায় নেই। রোগী যখন বুঝতে পারছেন, তখন তাঁর শরীরে বাসা বাঁধা জীবাণু অনেকটাই ডালপালা মেলে ফেলেছে সংস্পর্শে আসা মানুষদের মধ্যে। রোগ নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে যাঁদের খোঁজ পাওয়া অত্যন্ত জরুরি। যে কারণে করোনা মোকাবিলায় ‘কনট্যাক্ট ট্রেসিং’-এর উপর প্রবল গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
আরও একটা বিষয় গবেষকরা উল্লেখ করেছেন। তা হল, উপসর্গ দেখা দেওয়ার আটদিন পর থেকে রোগীর শরীরে ভাইরাল লোড কমতে থাকে। অর্থাৎ, রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা কমে যায়। রোগনির্ণয়ের পরে নয়, বরং আগেই কোভিড-১৯ বেশি ক্ষতিকর। “সবচেয়ে মারাত্মক এই প্রি-সিম্পটোম্যাটিক ট্রান্সিমিশন বা উপসর্গ পূর্ববর্তী সংক্রমণ।” বলছেন ভাইরোলজিস্ট ডা. সিদ্ধার্থ জোয়ারদার। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “এই গবেষণাপত্রে একটা বিষয় পরিষ্কার। তা হল, র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টই কোভিড মোকাবিলার সবচেয়ে বড় উপায়। অ্যান্টিবডি টেস্ট নয়। কারণ, ভাইরাস প্রবেশের ছয়-সাতদিন বাদে দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। কিন্তু রোগী সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়ায় তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে।”
একই বক্তব্য চিকিৎসক ডা. নিশান্তদেব ঘটকের। তাঁর মত, উপসর্গ দেখা দেওয়ার দু-তিন দিন আগে থেকে আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাস ছড়াতে থাকে। অর্থাৎ, কোনও ব্যক্তি যতক্ষণে বুঝতে পারছেন যে তিনি আক্রান্ত, ততক্ষণে তিনি আশপাশের বহু মানুষকে অজান্তেই সংক্রমিত করে ফেলেছেন। এই দু-তিন দিনে তিনি দশজনের সঙ্গে মিশে থাকলে তিনজনকে রোগের ছোঁয়াচ লাগাবেন। এই কারণেই ‘কনট্যাক্ট ট্রেসিং’ বা আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা লোকজনের তালিকা তৈরিটা খুব জরুরি।
কিন্তু সমস্যা হল, কাজটা নিখুঁতভাবে করা মুশকিল। আক্রান্ত ব্যক্তি একশো মানুষের সংস্পর্শে এলে বড় জোর নব্বই জনকে খুঁজে বের করা সম্ভব। বাকি দশ শতাংশ কিন্তু মুক্তভাবে সমাজে ঘুরবেন এবং রোগ ছড়াবেন। অর্থাৎ, রোগী কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে যাওয়ার আগেই রোগটা অনেকটা ছড়িয়ে ফেলছেন। আরও একটা সমস্যা। আমাদের দেশে কোনও ব্যক্তি আক্রান্তের সংস্পর্শে এলে তাঁকে চোদ্দো দিনের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। কিন্তু নেচার পত্রিকার গবেষণা বলছে, উপসর্গ দেখা দেওয়ার ২১ দিন পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাস ছড়াতে পারেন। তাই কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে ১৪ দিন কাটিয়ে আসার পরও হোম কোয়ারান্টাইনে ১৪ দিন থাকা উচিত। অথচ অনেক অসচেতন ব্যক্তি কোয়ারেন্টাইন থেকে ফিরে ঘরবন্দি না থেকে যথেচ্ছ ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বাজারেও যাচ্ছেন। এটা খুবই বিপজ্জনক। এই কারণেই রোগটি এতটা ভয়াল আকার নিতে পারছে।
গবেষণাপত্রে উল্লেখ, মোট ৯৪ জন কোভিড পজিটিভ রোগীর থেকে ৪১৪ বার লালারসের নমুনা বের করা হয়েছে। উপসর্গ দেখা দেওয়া থেকে ৩২ দিন পর্যন্ত এগুলি সংগৃহীত হয়েছে। দেখা গিয়েছে, শুরুর দিকে ভাইরাল লোড সবচেয়ে বেশি থাকে। ২০ দিন পরে লোড সবচেয়ে কম থাকে। কিন্তু পুরোপুরি নির্মূল হয় সংক্রমিত হওয়ার ৩৭ দিনের মাথায়। গবেষণার স্বার্থে আক্রান্ত ও সংক্রমিতদের দু’টি দল করা হয়েছে। প্রত্যেক দলে রাখা হয়েছে ৭৭ জন। ডা. সৌম্যকান্তি পণ্ডা জানিয়েছেন, কোনও বাড়িতে একজনের করোনা আক্রান্ত হওয়া মানে বাকিরাও ট্রান্সমিশন শৃঙ্খলে ঢুকে পড়লেন। এখন দুই সদস্যের আক্রান্ত হওয়ার মধ্যে যে সময়ের ব্যবধান তা যদি প্রথম আক্রান্তের ‘ইনকিউবেশন’-এর থেকে কম হয়, তাহলে বুঝতে হবে মাঝে আরও কিছু মানুষের শৃঙ্খলের মধ্যে রয়েছেন, যাঁরা উপসর্গহীন। অর্থাৎ ধরা পড়া রোগীর তুলনায়, আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি।
ইউহান-সহ বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালকে গবেষণায় যুক্ত করা হয়েছে। কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অসমঞ্জ চট্টরাজ জানিয়েছেন, ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে, উপসর্গ প্রকাশ পাবে কতদিনে, কতটা মজবুত হবে ‘ভ্যারিয়েশন ইন ট্রান্সমিশন চেন’। ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে অত সমস্যা হয় না। সাধারণত, যেদিন ভাইরাস শরীরে ঢুকবে সেদিনই নাক দিয়ে জল ঝরতে শুরু করে। সাত-আটদিন থাকে। তারপর শেষ হয়ে যায়। কোভিডে তা হচ্ছে না। করোনার প্রি-সিম্পেটোম্যাটিক পর্ব অনেক বড়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.