শিশু শরীরেও ডায়াবেটিসের থাবা। কোন ধরনের ডায়াবেটিসের কবলে কচিকাঁচারা? জানাচ্ছেন ফর্টিস হসপিটালের বিশিষ্ট এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ডা. সুজিত ভট্টাচার্য। লিখছেন শ্রীজা ঘোষ৷
শিশুর ডায়াবেটিস মানেই তা হল টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস। এটিকে ইনসুলিন নির্ভর ডায়াবেটিস বলা যেতে পারে। তবে বিগত ১০ বছরে যেভাবে পরিবেশ বা আমাদের জীবনযাপনে পরিবর্তন ঘটেছে তাতে ছোটবেলা থেকেই শরীরে ডায়াবেটিসের বীজ বপন শুরু হয়ে যায়। যার প্রভাবে মোটা হওয়া বা ওবেসিটিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের প্রবণতাই শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যাচ্ছে। যা কি না আগে চল্লিশ বছরের পরেই বেশি লক্ষণীয় ছিল।
ডায়াবেটিসের ধরন
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে ইনসুলিন হরমোন। এই হরমোনটি যখন অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলি থেকে নিঃসরণ হওয়া একদমই বন্ধ হয়ে যায় তখন ব্লাড সুগারের মাত্রা বাড়তে থাকে। তখন সুস্থ থাকতে বাইরে থেকে ইনসুলিন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এটি টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস। অন্যদিকে, ইনসুলিন ক্ষরণ হলেও তা যখন কোনও কাজ করতে পারে না। তখনও রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তবে এই ধরনের ডায়াবেটিস-এ রোগীকে ইনসুলিনের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হতে হয় না। যেহেতু এই ধরনের ডায়াবেটিস-এ ওজন বৃদ্ধি পায় তাই সেটি নিয়ন্ত্রণ রাখাই অত্যন্ত জরুরি এবং ট্যাবলেটেই কাজ হয়। পড়ের দিকে অনেকসময় ইনসুলিন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এটি টাইপ টু ডায়াবেটিস।
কারণ বুঝে
কেন টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস একটি নয় একাধিক কারণের সমন্বয়ে শরীরে বাসা বাধে। অর্থাৎ, বংশগত বা জিন ঘটিত কারণ অথবা পরিবেশগত কারণ। অর্থাৎ, শরীরে যদি কোনও সংক্রমণ ঘটে তাতে কখনও কখনও অগ্ন্যাশয়ের সবকটি কোষই নিস্তেজ হয়ে পড়তে পারে। এর ফলে ইনসুলিন ক্ষরণের ক্ষমতাও চলে যায়। এ ছাড়াও রয়েছে বংশগত বা জিন ঘটিত কারণ। সংক্রমণের ফলে ইমিউনোলজিক্যাল ইমব্যালান্স হলেওঅগ্ন্যাশয়ের কোষগুলি ধ্বংস হয়। অল্প বয়সে টাইপ টু ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ জীবনযাপন। অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়া, বাইরে খেলাধুলার অভ্যাস কম, পরিশ্রম কম, ছোট থেকে পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ, মানসিক চাপ। এছাড়া পারিবারিক সূত্রে ডায়াবেটিস হতে পারে।
লক্ষণ
বার বার খিদে ও তেষ্টা পাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব, অল্পতেই ক্লান্তি, পেটে ব্যথা বা ঘন ঘন বমি, তড়কা, ওজন কমেও যাওয়া, প্রস্রাবের জায়গায় (বিশেষ করে মেয়েদের) সংক্রমণ (ফাংগাল)।
সাবধানের বয়স
সাধারণত ৫ থেকে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত টাইপ ওয়ান ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জীবনযাপনের কারণে টাইপ টু ডায়াবেটিসেও এখন খুব অল্পবয়সেই (টিনএজ) ধরা পড়ছে।
সামাল দিতে
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস আগে থেকে রোধ করা বা একবার হয়ে গেলে তা থেকে সম্পূর্ণ সেরে ওঠা সম্ভব নয়। যদি ছোট বয়সেই লক্ষণ দেখা যায় তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তৎক্ষণাৎ ব্লাড সুগার টেস্ট করা জরুরি। নিয়মিত ইনসুলিন নিলে ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখলে দীর্ঘদিন সুস্থ ভাবে বাঁচা যায়। ইনসুলিন প্রতিস্থাপন করা এবং তা স্বাভাবিকভাবে পুনরাবৃত্তি করা বিশাল চ্যালেঞ্জ। তবে এখন সিরিঞ্জের বদলে পাম্পের সাহাযে্যও ইনসুলিন নেওয়া হয়। সুগার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কি না জানতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ফাস্টিং ও র্যানডাম (random) সুগার লেভেল ও HbA1C পরীক্ষা করাতে হয়। সুগারের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলেও বিপদ হতে পারে।
পারিপার্শ্বিক ক্ষতি
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের প্রভাবে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিডনি, দৃষ্টিশক্তি, নার্ভাস সিস্টেম, চোখ ও হার্ট। তবে এটি নির্ভর করে যে রোগটি শিশুটির শরীরে কতদিন ধরে বাসা বেঁধেছে এবং কীভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে তার উপর।
টাইপ টু ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে সঠিক জীবনযাপন, ওজন নিয়ন্ত্রণ করে এবং ওষুধ খেয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলে পারিপার্শ্বিক ক্ষতি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব।
মা-বাবা সতর্ক হোন
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের বাবা-মায়ের দায়িত্ব ও চাপ অনেক বেশি। এক্ষেত্রে শিশুকে দিনে চারবার ইনসুলিন নিতে হয়।
রোজ অন্তত আধ-এক ঘণ্টা বাচ্চাকে মাঠে খেলতে দিন। যোগ ব্যায়ামও করাতে পারেন। তবে সমবয়সিদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে খেললে শরীরে মেদ জমার প্রবণতা কমার পাশাপাশি শিশুর মনের চাপও কমে।
প্রয়োজনে হাঁটাহাঁটি, জগিং করাতে হবে। পড়াশোনায় ভাল রেজাল্ট, কেরিয়ার নিয়ে চাপ দেবেন না। স্কুল-কোচিংয়ের বাইরের জগতের সঙ্গে আনন্দে সময় কাটাতে দিন।
ভাজাভুজি, তেলযুক্ত খাবার, ফাস্ট ফুড না দিয়ে সবুজ, টাটকা শাকসবজি, মাছ, ডিম খাওয়াতে হবে। সাধারণত, লো-ফ্যাট, লো-কার্বোহাইড্রেট, হাই প্রোটিনের ডায়েট মেনে চলতে বলা হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.