সোমা মজুমদার: কয়েকদিন ধরেই ক্লান্তি অনুভব করছেন? একটু পরিশ্রম করতে না করতেই ঝিমিয়ে পড়ছেন? কিংবা পুজোর মুখে সুন্দর মুখখানি দেখতে ফ্যাকাশে লাগছে? দেরি নয়, শীঘ্রই রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিন৷ কারণ অজান্তেই আপনি অ্যানিমিয়াতে আক্রান্ত হতে পারেন৷ যা প্রেগন্যান্সির সময়ে গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে পারে৷ দীর্ঘদিন অবহেলা করলে হতে পারে ক্যানসারও৷
যদিও ডাক্তারি পরিভাষায় অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা কোনও রোগ নয়৷ রোগের উপসর্গ৷ কোনও কারণে শরীরে রক্ত তৈরি না হলে বা তৈরি হলেও তা সরে গেলে রক্তাল্পতা দেখা দেয়৷ রক্তের লোহিতকণিকা, শ্বেতকণিকা, অণুচক্রিকা কমে গেলেও অ্যানিমিয়া হয়৷ বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে বেশিরভাগ মহিলা অ্যানিমিয়ায় ভোগেন৷ কয়েক বছর আগে একটি সমীক্ষায় ধরা পড়েছে যে কলকাতায় ৯০% মানুষ রক্তাল্পতার শিকার৷ ভারতে পুরুষদের শরীরে রক্তের মাত্রা ১৩-এর নিচে এবং মহিলাদের ১২-এর নিচে থাকলে রক্তাল্পতা বলে ধরা হয়৷ অনেক সময় দীর্ঘদিন অবহেলা করলে অ্যানিমিয়া বাচ্চাদের এবং বড়দের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতার উপরও প্রভাব ফেলে৷
কারণ:
• নিউট্রিশন বা অপুষ্টির কারণে এ দেশে সবচেয়ে বেশি রক্তাল্পতা হয়৷ যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল রোজকার খাদ্যতালিকায় আয়নের ঘাটতি৷ সুষম আহারের অভাবে বেশিরভাগ মানুষ রক্তাল্পতায় ভোগেন৷ খাবার ঠিকমতো না ধুয়ে খেলে বা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না করলে কৃমি হয়, যা রক্তাল্পতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ৷
• রক্ত তৈরিতে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল আয়রন, ফলিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন বি১২৷ এর ফলে প্রাণীজ প্রোটিনে সবচেয়ে বেশি ভিটামিন বি ১২ থাকে৷ যাঁরা নিরামিশাষী, তাঁদের অনেক সময় ভিটামিন বি১২-এর ঘাটতি দেখা যায়৷ এর ফলে অ্যানিমিয়া হয়৷
• কোনও কারণে রক্তক্ষরণ হলে শরীরে চাহিদার নিচে রক্তের মাত্রা নেমে যায়৷ সেক্ষেত্রেও রক্তাল্পতা লক্ষ্য করা যায়৷ মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের কারণে এই রক্তক্ষরণের প্রবণতা বেশি থাকে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় আয়রনের খামতি দেখা যায়৷ ঋতুচক্র ঠিকঠাক না হলেও রক্তাল্পতা হয়৷ কোষ্ঠকাঠিন্য, আলসার, অর্শ রোগের জন্য অন্ত্র বা পাকস্থলী থেকে রক্তক্ষরণ হলেও শরীরে রক্তের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়৷
• হার্টের সমস্যা বা বিভিন্ন অসুখের জন্য আজকাল বহু মানুষ অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খেয়ে থাকেন৷ এর ফলেও আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়৷ এছাড়া কিডনির অসুখেও রক্তাল্পতা দেখা যায়৷ কিডনির ক্রিয়া ঠিকমতো না হলে রক্ত যথাযথভাবে তৈরি হতে পারে না৷
অজান্তে অ্যানিমিয়া:
ডায়াবেটিস, আর্থারাইটিস, বাতের কারণে অ্যানিমিয়া হয়৷ ‘পেইন কিলার’ জাতীয় ওষুধ ঘন ঘন ফেলে বা দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড খেলে অজান্তেই রোগী অ্যানিমিয়ায় ভোগেন৷
সাবধানতা:
চল্লিশোর্ধ্ব কোনও ব্যক্তি বা মহিলার হঠাৎ গ্যাসট্রিকের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে কি না তা বুঝতে অবশ্যই এন্ডোস্কোপি, কোলোনোস্কোপি টেস্ট করানো উচিত৷ রক্তক্ষরণ বাড়তে থাকলে গ্যাসট্রিক ক্যানসার হতে পারে৷ এক্ষেত্রে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে যে গলগল করে রক্ত বের না হলে শরীরে কোনও প্রভাব পড়ে না, কিন্তু আদতে তা নয়৷ বরং শরীরে সামান্য রক্তক্ষরণ দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে আপনি ক্যানসারের মতো মারণরোগের দিকে এগোতে থাকবেন৷ আবার অনুচক্রিকা, শ্বেতকণিকা কমে যাওয়ার পিছনে অনেক সময় ব্লাড ক্যানসার বা আরও ভয়াবহ রোগ লুকিয়ে থাকে৷ তাই এই ধরনের কোনও সমস্যায় প্রথম অবস্থাতেই পরীক্ষা করে সঠিক চিকিৎসা না করে অবহেলা করবেন না৷
লক্ষণ:
• অল্পে ক্লান্ত হয়ে পড়া৷
• দুর্বলতা৷
• ফ্যাকাশে মুখ বা ত্বকে হলদেভাব৷
• অনিয়মিত হৃদস্পন্দন৷
• নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা৷
• মাথা ঘোরা৷
• বুকে ব্যথা৷
• হাত-পায়ের পাতা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া৷
• মাথায় ব্যথা৷
ডাক্তারের কাছে কখন যাওয়া উচিত:
অল্প পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়লে অথবা বিশেষ কোনও কারণ ছাড়াই অবসাদগ্রস্ত দেখালে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত৷ এসব ক্ষেত্রে আয়রন, ভিটামিন বি১২-এর ঘাটতির জন্য অ্যানিমিয়া বেশি হয়৷ তবে অ্যানিমিয়া ছাড়াও ক্লান্তি বা অবসাদের আরও অনেক কারণ থাকতে পারে৷ তাই ক্লান্ত অনুভব হলেই ধরে নেবেন না আপনার রক্তাল্পতা হয়েছে৷
কী কী খাবেন:
শরীরে আয়রনের জোগান দিতে পারে কুলেখারা পাতা৷ এছাড়া কাঁচকলা, পেয়ারা, সবুজ শাকসবজি, বেদানা, খেজুর, মাংসের মেটে অ্যানিমিয়া কমাতে সাহায্য করে৷ লোহার কড়াইয়ে রান্না করলে শরীরে আয়রন বা লোহা যায়৷ আয়রনের মাত্রা বাড়াতে বেশি দামি ওষুধের প্রয়োজন নেই৷ হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের থেকে কমে গেলে দিনে তিনটে করে সাপ্লিমেন্ট ট্যাবলেট খেতে হয়৷ ঠিকমতো খেলে ১০ দিনে ১ গ্রাম মতো হিমোগ্লোবিন বাড়তে পারে৷
কী করবেন না:
• যখন তখন ‘পেইন কিলার’ বা ব্যথার ওষুধ খাওয়া উচিত নয়৷
• ধূমপান এবং মদ্যপান বর্জন করুন৷
• স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করুন৷ অনেকক্ষণ খালিপেটে থাকা চলবে না৷
গর্ভাবস্থায় সতর্কতা:
রক্তাল্পতার কারণে এ দেশে ৪০ শতাংশ প্রসূতির মৃত্যু হয়৷ হিমোগ্লোবিন ৮-এর নিচে নেমে গেলে কম ওজনের শিশু জন্মানোর আশঙ্কা বাড়ে৷ আর হিমোগ্লোবিন ৫-এর নিচে নামলে ভাবী মায়ের মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যায় ৮-১০ গুণ৷ কাজেই হিমোগ্লোবিন ১০-এর উপরে না রেখে অন্তঃসত্ত্বা হলে যথেষ্ট ঝুঁকি থাকে৷
থ্যালাসেমিয়ায় সতর্কতা:
থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে রক্তে হিমোগ্লোবিন ১০-১২-এর মধ্যে হতে পারে৷ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের আয়রন জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত নয়৷ তাই রক্ত কমলেই চোখ বন্ধ করে আয়রন জাতীয় খাবার খাবেন না৷ কারণ থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আয়রন শরীর থেকে বের করার জন্য ওষুধ নিতে হয়৷ এই ধরনের কোনও সমস্যার সম্মুখীন হলে অবশ্যই আপনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না তা পরীক্ষা করে জেনে নিন৷
আরও জানতে এনআরএস হাসপাতালের হেমাটোলজিস্ট ডাক্তার প্রান্তর চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন এই নম্বরে- 9830032861। এছাড়া ক্লিক করে দেখে নিন epaper.sangbadpratidin.in
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.