মণিশংকর চৌধুরী: ‘লাও তো বটে কিন্তু আনে কে’। করোনা কালে কল্পতরু হতে দেখা গিয়েছে মোদি সরকারকে। পিছিয়ে নেই রাজ্যগুলিও। শুধু অতিমারী বলেই নয়, নির্বাচনের আগেও বারবার এমনভাবেই জনমোহিনী হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীন দল। আর এখানেই উঠছে প্রশ্ন। দীর্ঘমেয়াদে ‘বিনি মাগনার’ এই ধরনের প্রকল্প কি চাপে ফেলছে দেশের অর্থনীতিকে? গত কয়েকবছরে জিডিপি’র করুণ হাল সে প্রশ্নকে আরও জোরদার করেছে। জনমোহিনী প্রকল্পের নামে ‘পাইয়ে দেওয়ার’ এই খেলা অর্থনীতিকে প্যাঁচে ফেলতে পারে বলে প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করেছেন কেন্দ্রের সচিবরা। এবার আমলাদের যুক্তির পালটা দিলেন তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ (Kunal Ghosh)। তাঁর সাফ কথা, “জনতাকে বঞ্চিত করা যাবে না।”
বাংলা-সহ একাধিক রাজ্য দেদার জনমোহিনী প্রকল্প আনছে। যার দরুন বেহাল অবস্থা হচ্ছে রাজ্যের কোষাগারের। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে অনেকের অবস্থাই গ্রিস বা শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে বলে সতর্ক করছেন আমলারা। এমনকী, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমলাদের এক বৈঠকেও প্রসঙ্গটি উঠে আসে। সেখানে রীতিমতো সতর্ক করেছিলেন কেন্দ্রীয় সচিবরা।
সবেমাত্র করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি। মানুষের হাতে টাকা নেই। তাই বাজারে অর্থের জোগান বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিল অর্থনীতিবিদদের একাংশ। পাশাপাশি সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির পায়ের তলার মাটি মজবুত করতেও কেন্দ্র-রাজ্য সকলেই একাধিক প্রকল্প এনেছে, যেখানে হয় মানুষের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা দেওয়া হচ্ছে নয়তো দেওয়া হচ্ছে ভরতুকি। করোনা কালে কেন্দ্র সরকার টানা তিন মাস নিম্নবিত্ত মহিলাদের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠিয়েছে। আবার কৃষকদেরও প্রতি বছর ৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়। ভরতুকি মেলে রান্নার গ্যাস-সহ একাধিক ক্ষেত্রে। এছাড়া তো ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’য়ের মতো প্রকল্প রয়েইছে, যেখানে বছরে সরকারের কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। পিছিয়ে নেই রাজ্যও। মহিলাদের জন্য রয়েছে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’, ছাত্রীদের জন্য ‘কন্যাশ্রী’, বিবাহযোগ্যাদের জন্য ‘রূপশ্রী’-সহ একাধিক প্রকল্প। কিন্তু কত দিন এই প্রকল্প টানতে পারবে কেন্দ্র-রাজ্য, ভাঁড়ারে টান পরবে না তো, আশঙ্কায় ভুগছে আমলারা। তাহলে কি কেন্দ্র-রাজ্যের এই প্রকল্পগুলি বন্ধ করে দেওয়া হবে?
এ প্রসঙ্গে উত্তর দিতে গিয়ে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন,”মানুষের হাতে সরাসরি টাকা পৌঁছে দিতে হবে, যে পথ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন। লকডাউনের সময় যখন মানুষের কাজ নেই তখন এই সরাসরি সাহায্য়টা দরকার। অর্থনীতিবিদরা একটা বড় অংশ বলছে, যখন মন্দা চলে তখন রাষ্ট্রকে তার কোষাগার থেকে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষকে সরাসরি অর্থ হাতে পাইয়ে দেয়। তাহলে স্থানীয় অর্থনীতি সচল থাকে। এই মডেলটাকে দেশে অস্বীকার করতে পারেন না।” এর পরই মোদি সরকারের সমালোচনা করে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তোপ দাগেন, “কেন্দ্রের সার্বিক আর্থিক পরিকল্পনাটাই ব্যর্থ হচ্ছে। তাই বিপদ তৈরি হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে মানুষকে সাহায্য় দেওয়া যাবে না।”
এই বিষয়ে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তথা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বলছেন, “নজরে রাখতে হবে রাজ্যের ঋণ লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে কি না। রাজ্য যদি আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খরচ করে তাহলে কারোর কিছু বলার নেই। আমাদের স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট যতটা বৃদ্ধি পাচ্ছে তার তুলনায় আমাদের ঋণ ততটা বাড়েনি। তাই এখনই এতটা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। উত্তরপ্রদেশে তো বহু জনমোহিনী প্রকল্প হয়েছে, সেটা নিয়ে তো কেউ কিছু বলছে না। বাংলার তুলনায় উত্তরপ্রদেশেও ধার খুব একটা কম নয়। আসালে মোদির সামনে কারোর কিছু বলার সাহস নেই। ” অন্যদিকে ভারত চেম্বার অফ কমার্সের এমএসএমইর চেয়ারম্যান সৌরভ খেমানির মত, “খয়রাতির ক্ষেত্রে জনতার করের টাকা কেন ব্যবহার করবে সরকার, যে রাজ্য সরকার হোক কিংবা কেন্দ্র সরকার? করোনার পর সব কোষাগারেই টান পড়েছে, এখন এত খয়রাতি করার মতো অবস্থা কারোরই নেই। তাই আমলারা যে সতর্কবার্তা দিচ্ছেন সেটা সঠিক।” তাঁর পরামর্শ, “জনগণের করের টাকায় খয়রাতি না করে সেই অর্থে কর্মসংস্থান করুক সরকার। পশ্চিমবঙ্গে শিল্প গড়ে উঠলে আখেরে লাভ রাজ্যের।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.