কৃষ্ণকুমার দাস: ১৯৮৪ সালে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ ভোর তিনটায় যাদবপুর কেন্দ্রের ফল প্রকাশ হতেই দেশ জেনেছিল দুঁদে ব্যারিস্টার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন কালীঘাটের টালির চালের বাসিন্দা এক তরুণী, নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। তাঁর নিজের কথায়, যাদবপুর আমার রাজনৈতিক জন্মভূমি। তাই আজও ওই কেন্দ্রের অধিকাংশ মানুষ ভোট দেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, শুধুই মমতারই মুখ ও অসংখ্য উন্নয়নের উজ্জ্বল কীর্তিমালা সামনে রেখেই। বস্তুত সেই কারণেই এবারও তৃণমূলের প্রার্থী সায়নী ঘোষ (Saayoni Ghosh) প্রচারে নেমে বলছেন, ‘‘আমি দিদির দূত, ৪০ বছর আগে যুবনেত্রী মমতাদিকে আশীর্বাদ করেছিলেন, আমি দিদির প্রতিনিধি হয়ে এসেছি, তাঁরই কাজের ধারা বজায় রাখার সুযোগ দিন।’’ অন্য দুই প্রার্থী সিপিএমের তরুণ মুখ সৃজন ভট্টাচার্য ও বিজেপির অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়ও প্রচারে নেমে গ্রামে-শহরে ঘুরে বুঝতে পারছেন, ‘লড়াইটা খুবই কঠিন, যাদবপুরে প্রতিদ্বন্দ্বী আসলে স্বয়ং মমতা।’’
টালিগঞ্জ থেকে বারুইপুর, সোনারপুর, ভাঙড়, যেখানেই মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছি, বাম-বিজেপির সমর্থকরাও স্বীকার করছেন, ‘‘যাদবপুর লোকসভা (Jadavpur Lok Sabha) মমতার মাটি, তৃণমূলের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। এখানে মমতার প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়াই মানে স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটা। ২০১১ সালে স্বয়ং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যাদবপুর বিধানসভায় হেরে গিয়েছেন স্রেফ মমতা-ঝড়ে।’’ বারুইপুর পশ্চিমের বিধায়ক স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়,‘‘এখানকার মানুষ মুখ্যমন্ত্রীকে ১০০ শতাংশ বিশ্বাস করেন, আস্থা রাখেন, ভরসার ঠিকানা বলে গত ৪০ বছর ধরে জানেন। উনি যাঁকেই প্রার্থী করে পাঠান, তাঁকেই মানুষ বিপুল ভোটে জিতিয়ে দেন।’’ একথা ঠিক, গত ৪০ বছরের মধ্যে মালিনী ভট্টাচার্য ও সুজন চক্রবর্তীকে বাদ দিয়ে বাকি ৩০ বছরই যাদবপুর কেন্দ্রে মমতার পাঠানো প্রার্থীরাই বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতে সংসদে গিয়েছেন। ভাঙড়ের শোনপুর বাজারে চায়ের দোকানে বসে একান্ত আলাপচারিতায় সিপিএমের জেলা কমিটির এক প্রবীণ সদস্য স্বীকার করলেন, ‘‘পার্টির থেকে যতই নিয়োগ দুর্নীতির কথা প্রচার করি না কেন, যাদবপুরের ভোটারদের একটা বড় অংশ মমতাকেই বিশ্বাস করে জোড়াফুলে ভোট দেবেন।’’ বস্তুত সেই কারণেই নেতাজি পরিবারের দুই শিক্ষাবিদ মা কৃষ্ণা বসু ও ছেলে সুগত বসু, গায়ক কবীর সুমন এবং শেষ পাঁচবছরে অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীকে প্রার্থী করে পাঠালেই ভোটাররা সকলকে সংসদে পাঠিয়েছেন। যদিও সোনারপুরে নির্বাচনী সভায় এসে সাংসদ হিসাবে মিমি যে যাদবপুরকে সময় দেননি তা প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। প্রাক্তন একাধিক সাংসদের ভূমিকায় যে খুব একটা খুশি নন সোনারপুর-বারুইপুরের তৃণমূলকর্মীরা তার প্রমাণ মিলেছে স্পিকারের কথায়। বলেছেন,‘‘আমরা নির্বাচন করি রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সৈনিক হিসাবে। আর মানুষ ভোট দেবেন উন্নয়নকে চোখে দেখে।’’
সায়নী ও সৃজন, দুই তরুণ প্রার্থী মুখোমুখি লড়ছেন। প্রচারে ও প্রভাবে সায়নী অনেকটাই এগিয়ে, তবে বাংলার অন্য কেন্দ্রের তুলনায় যাদবপুরে বামপ্রার্থীর হোর্ডিং-ফ্লেক্স চোখে পড়ছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সায়নী আসানসোল দক্ষিণে অগ্মিমিত্রা পালের কাছে ও সায়ন হুগলির সিঙ্গুরে বেচারাম মান্নার কাছে হেরে যান। সৃজন সিঙ্গুরে মাত্র ১৪.৬ শতাংশ ভোট পেয়ে বিধানসভা ভোটে জামানত খুইয়েছিলেন। উল্টোদিকে সায়নী মাত্র চার হাজার ভোটে বিজেপি প্রার্থীর কাছে হেরে যান। বিজেপির প্রার্থী অনির্বাণ লাহিড়ীও গত বিধানসভা ভোটে বীরভূমের বোলপুর কেন্দ্রে মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহর কাছে পরাজিত হন। স্বভাবতই তিনবছর পর ফের তিনজনেই সাংসদ হওয়ার দৌড়ে যাদবপুরের ট্র্যাকে নেমেছেন। বিধানসভা ভোটে হারলেও অত্যন্ত সুবক্তা সায়নী অভিনয়ের পাশাপাশি প্রায় তিনবছর ধরে রাজ্য তৃণমূল যুব সভানেত্রী হিসাবে বাংলায় ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মসূচি চালিয়ে গিয়েছেন। প্রায় ২৫ বছর ধরে শিক্ষাবিদ-গায়ক-অভিনেত্রীর পর সায়নীর মতো অভিনেত্রী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে প্রার্থী করেছেন তৃণমূলনেত্রী। আর প্রার্থী হয়েই গত ২ মাস ২০দিনে ভাঙড়, যাদবপুর, টালিগঞ্জ, সোনারপুর ও বারুইপুর চষে ফেলেছেন টালিগঞ্জের ভূমিকন্যা সায়নী। কিন্তু যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই দেখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাঁর নিজের কথায়,‘‘যে পাড়ায় যাচ্ছি সেখানে মানুষ বলছেন, জানেন দিদি এই মাদ্রাসায় আসতেন, এই বাড়ির বারান্দায় বসেছিলেন, এই উড়ালপুল করেছেন, এই স্কুল উচ্চ মাধ্যমিক করেছেন। তাই দিদির অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন সামনে রেখে ভোট চাইছি।’’ একটা বিষয় স্পষ্ট, সৃজন প্রার্থী হওয়ায় রামে চলে যাওয়া বহু ভোট বামে ফিরবে। অবশ্য অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভাঙড়ের সভায় এসে বলে গিয়েছেন,‘‘যাদবপুরের লড়াই ডায়মন্ডহারবারের সঙ্গে মার্জিন নিয়ে।
যাদবপুরের সাত বিধানসভার মধ্যে ছয়টিতেই তৃণমূলের দাপুটে বিধায়করা এত মজবুত সংগঠন তৈরি করেছেন যে, বিরোধীরা অর্ধেক বুথেও পোলিং এজেন্ট দিতে পারবে না। টালিগঞ্জে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস শুধু দক্ষ সংগঠক নন, উন্নয়নেও রাজ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিধায়ক। সেই অরূপই এবারও যাদবপুরে তৃণমূলের ভোটযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি। পাশাপাশি বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভাস সর্দাররা বারুইপুর পূর্ব-পশ্চিমকে উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে দিয়েছেন। অন্যদিকে যাদবপুরে মলয় মজুমদার ও সোনারপুর উত্তর-দক্ষিণে যথাক্রমে ফিরদৌসি বেগম-লাভলি মৈত্ররা উন্নয়নের নতুন দিশা দেখিয়েছেন। অবশ্য আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির ভাঙড়ে তৃণমূল একটু চাপে আছে বলে স্বীকার করছেন জোড়াফুলের ভোট সেনাপতিরা। কারণ, সোনারপুর-বারুইপুরে যে হারে উন্নয়ন হয়েছে তার অর্ধেকও ভাঙড়ে হয়নি বলে অভিযোগ। নিউটাউনের লাগোয়া কিন্তু ভাঙড়-২ ব্লকে আজও একটিও সরকারি বাসরুট হয়নি। বহু রাস্তা কাঁচা, রাস্তায় আলো নেই, নিকাশি নেই। গত বিধানসভা ভোটে আইএসএফ জেতায় উল্টে এলাকায় অশান্তি বেড়েছে, উন্নয়ন থমকে গিয়েছে বলে দাবি বাসিন্দাদের একাংশের। ক্ষোভ জমেছে আইএসএফ নওশাদ সিদ্দিকির বিরুদ্ধেও। এলাকায় আসেন না, পুলিশ-কেস খেলে কর্মীদের দেখেন না। তাই আইএসএফ শিবিরে এখন ভাটার টান থাকলেও সংখ্যালঘু ভোট কাটবে প্রচুর। দীর্ঘদিন জেলে থাকায় আরাবুল ঘনিষ্ঠরা ক্ষুব্ধ, কাইজার নিষ্ক্রিয়। তবে ভাঙড়ের ভোটের দায়িত্বে ক্যানিংয়ের বিধায়ক শওকত মোল্লা। তাই এবার ভাঙ়ড়ে মেরুকরণের রাজনীতিতে জোর দিয়েছে বিজেপি। কিন্তু একদিকে টালিগঞ্জ-গড়িয়া মেট্রো থেকে শুরু করে বারুইপুর-সোনারপুরে উড়ালপুল, রাস্তা, আইটিআই, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল-সহ কয়েক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন করা মমতার ছায়ার সঙ্গে এবারও লড়াইয়ে পেরে উঠছেন না বিজেপি বা বামপ্রার্থী। এর উপর বাঘাযতীনের সভায় এসে উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দাদের জন্য বাড়ি তৈরি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা আরও উজ্জীবিত করেছে তৃণমূলের ভোটারদের। সঙ্গে পুর্ববঙ্গীয় ভোটব্যাঙ্কে এনআরসি ও ওবিসির নিয়ে হাইকোর্টের রায়, বিজেপি শিবিরকে জোর ধাক্কা দেবে।
সাউথ পয়েন্ট, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সৃজন এবার সাদাচুলের বামপন্থী রাজনীতির উল্টো স্রোতে হাঁটা এক ঝলক তাজা বাতাস। নতুন প্রজন্মের ভোটার ও বামেরা তাঁকে নিয়ে লড়াইয়ের স্বপ্ন দেখছে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দির গেটের উল্টোদিকের বাসস্ট্যান্ডে দেখা সুফল নস্কর নামে এক প্রৌঢ় স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে। বললেন,‘‘আগেরবার রামে ভোট দিয়েছিলাম, এবার সৃজন প্রার্থী, ওকেই দেব।’’ যাদবপুর গাঙ্গুলিবাগানে জেলা জোনাল কমিটির এক প্রবীণ পার্টি কর্মীর সাথে। তিনি স্বীকার করলেন,‘‘শুধু তৃণমূল বিরোধিতার নামে উন্নয়নের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা লোকসভা-বিধানসভায় শূন্য হয়েছি। ১৩ বছরে মমতা অনেক কাজ করেছেন, আমরা উষা-ডাবর-সুলেখা বন্ধ করে বহুতল তুলেছি। তাই তৃণমূলের উন্নয়নের বিরুদ্ধে ও দুর্নীতির ইস্যু নিয়ে এবার ভোটে (West Bengal Lok Sabha Election 2024) খুব বেশি হলে আমরা দ্বিতীয় হতে পারি, প্রথম হওয়া সম্ভব নয়।’’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.